প্রাচীন বাংলায় ক্ষমতা বদলের ক্ষত, থানার মালখানায় পড়ে বিষ্ণুমূর্তি
বর্তমান | ০৯ নভেম্বর ২০২৪
দীপন ঘোষাল, রানাঘাট: ঘরের ভিতর বাজেয়াপ্ত হওয়া মালের ডাঁই। অস্ত্রশস্ত্র থেকে শুরু করে আরও কতকিছু। পুলিসের খাতায় কলমে সেটা মালখানা। সেখানেই পড়ে কুচকুচে কালো পাথরের একটা চাঁই। ফুট দু’য়েক উচ্চতা। ঘরের বাকি জিনিসপত্রের সঙ্গে বেশ বেমানান। একটু খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায় পাথরটি আসলে ভগবান শ্রীবিষ্ণুর মূর্তির ভাঙা অংশ। ডান দিক থেকে বাঁ দিকের উপর পর্যন্ত আড়াআড়িভাবে ভাঙা। মূর্তির মুখটিও বিকৃত করতে ভেঙে ফেলা হয়েছে। যাতে চেনা না যায়!
কিন্তু প্রশ্ন হল থানার মালখানায় ভঙ্গুর বিষ্ণুমূর্তিটি এল কীভাবে? সময়টা আনুমানিক ২০০৯ সালের মাঝামাঝি। জমিতে চাষ করতে গিয়ে বেশ কিছুটা মাটি খুঁড়ে ফেলেছিলেন স্থানীয় এক কৃষক। সেই গর্তের মধ্যে কালো পাথরের একটি স্তর দেখতে পান তিনি। কৌতূহলী হয়ে আরও বেশ খানিকটা মাটি সরিয়ে ফেলেন। তারপর যা দেখলেন তাতে ভিড়মি খাওয়ার জোগাড়! বেরিয়ে এসেছে কালো পাথরের একটি বিষ্ণুমূর্তি! ঘটনাটি উল্কার গতিতে ছড়িয়ে পড়ে। এলাকার মানুষ এসে ভিড় করেন। মূর্তিটি উদ্ধার করে গাংনাপুর থানায় নিয়ে আসা হয়। এরপর প্রায় দেড় দশক অতিক্রান্ত। বর্তমানে থানার মালখানায় আর পাঁচটা অপ্রাসঙ্গিক সামগ্রীর সঙ্গে অনাদরে পড়ে রয়েছে বিষ্ণুমূর্তিটি। যেটা আসলে প্রাচীন ‘নৌদিয়া’ (নদীয়া জেলার আদি নাম)-এর জীবন্ত ইতিহাসের সাক্ষী। যে ইতিহাসের একটা বড় অধ্যায়জুড়ে রয়েছে, বাংলায় শাসন ক্ষমতার পটপরিবর্তন—তুর্কিদের হানা, রায় লখমনিয়া (লক্ষ্মণ সেন)’র পলায়ন। সময়টা ১২০৪ সাল।
চারিদিকে জঙ্গল ঘেরা। কমবেশি এক বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ঢিবি। একটা টাওয়ার, কয়েকটি পরিখার ধ্বংসাবশাসের উঁকিঝুঁকি। প্রাচীন ইটের ঘেরা দেওয়ালের কিছু স্তুপ—সব মিলিয়ে নদীয়ার গাংনাপুরের একটা অংশ। স্থানীয়রা বলেন, ‘দেবল রাজার গড়’। দেবল রাজ? বাংলায় এমন রাজার নাম ইতিহাসের পাতায় উল্লেখ নেই। তবে, ঐতিহাসিকরা বলছেন, এই দেবলগড় আদতে পাল এবং সেন যুগের উন্নত ব্যবসায়িক এবং প্রশাসনিক ক্ষেত্র। আজকের ধ্বংসাবশেষ তারই আকর। অথচ, মাটির নীচে চাপা পড়ে যাওয়া ইতিহাস টেনে বের করে আনতে কেন যে জায়গাটি সরকারি উদ্যোগে সেভাবে খোঁড়াখুঁড়ি হল না, সেটাই আশ্চর্যের। ঐতিহাসিকদের একটি বড় অংশ মনে করেন, বাংলার প্রাচীন ইতিহাসের বিশাল একটি অজানা অধ্যায় লুকিয়ে রয়েছে দেবলগড়ের ভূগর্ভে। মালখানায় পড়ে থাকা ওই বিষ্ণুমূর্তিটি সেটাই ইঙ্গিত করে। মূর্তিটিকে নিয়েও আজ পর্যন্ত প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা কেন হল না, সেই প্রশ্নও উঠেছে।
গাংনাপুরের এই ‘দেবল রাজার গড়’ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই গবেষণা করে যাচ্ছেন জিও আর্কিওলজিস্ট তথা অধ্যাপক ডঃ বিশ্বজিৎ রায়। তিনি বলছিলেন, ‘মূর্তিটি আনুমানিক একাদশ শতকের। অর্থাৎ, সেনদের আমলের। দেবলগড়ে তাঁদের অবস্থানের অন্যতম সাক্ষী এই বিষ্ণুমূর্তিটি। এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিরাট। কিন্তু ভাবতে অবাক লাগছে, মূর্তিটি মিউজিয়ামে না রেখে কেন মালখানায় পড়ে! মূর্তিটি গবেষণার সুযোগ কেন হেলায় হারানো হচ্ছে বুঝতে পারছি না।’ জিও অর্কিওলজিস্টদের একটি অংশের মতে, মূর্তিটি আড়াআড়ি ভাঙা। ব্যাসাল্ট পাথরে একমাত্র লম্বালম্বি ফাটলই সম্ভব। তাছাড়া মূর্তির মুখটি যেভাবে বিকৃত দেখাচ্ছে, সেটা মোটেও স্বাভাবিক ক্ষত নয়। ইচ্ছাকৃতভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। কেননা, ক্ষমতার পটপরিবর্তন কালে এক রাজার তৈরি সৌধ, তোরণ, মূর্তি অন্য রাজা ধ্বংস করে দেবেন, সেটাই দস্তুর। ইতিহাসে এমন ভুরি ভুরি প্রমাণ রয়েছে।
অতঃপর, মালখানায় অবহেলায় পড়ে থাকা ভাঙা বিষ্ণুমূর্তির গায়েও সম্ভবত লেপটে রয়েছে বাংলায় ভাঙা-গড়ার ইতিহাস। মিনহাজ়-ই-সিরাজ রচিত ‘তবাকৎ-ই-নাসিরি’ গ্রন্থটি সেই ইতিহাসের আকর। সেখানকার কোনও অধ্যায়ে এই বিষ্ণুমূর্তি হয়তো মিলিয়ে দিতে পারে গাংনাপুর…দেবলগড়…লক্ষ্ণণ সেন এবং তুর্কি যুবক বখতিয়ার খিলজিকে!