মধ্য কলকাতার রফি আহমেদ কিদোয়াই রোডের ফ্ল্যাটে সোফায় বসে ভরদুপুরে মোবাইলে মগ্ন ছিল অস্মিত। রান্নাবান্নার ভিডিয়ো বেশ পছন্দ তার। ভাল লাগে কুমোরপাড়ায় প্রতিমা গড়া দেখতে, ‘পাপা’-র হাত ধরে বাজারে যেতে। জেঠামশাই আর চার বছরের বড় দিদির সঙ্গে দুষ্টু-মিষ্টি সম্পর্ক। আগন্তুক ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই অবশ্য তাঁর রঙিন ব্যাগের টানে মোবাইল ফেলে কাছে চলে এল সে। মায়ের বারণ শুনে কিঞ্চিৎ পিছপা। তবে দু’-এক শব্দে নিজের পছন্দ-অপছন্দের কথাও জানান দিতে ভোলে না সে।
সমস্যার শুরু কবে থেকে? পেশায় ব্যবসায়ী অরিন্দম ও গৃহবধূ অরুজার দ্বিতীয় সন্তান অস্মিত। তার আড়াই বছর বয়সে অটিজ়ম ধরা পড়ে। যদিও আগেই অরুজা কিছু সন্দেহ করেছিলেন। ‘‘মেয়ে অনুষ্কা এক বছর বয়সেই কত কথা বলত। অথচ ছেলে প্রায় কিছুই বলত না। পরে পরীক্ষা করে জানা গেল, ও অটিস্টিক। তখন তো অটিজ়ম শব্দটার মানেই জানতাম না! ডাক্তার যখন ওর সমস্যার কথা বলছেন, তখন মনে হয়েছিল, এ সব কী বলছেন উনি! ছেলে তো সুস্থ!’’ গলা বুজে আসে অরুজার। পাশে বসা তাঁর ‘বাবু’ তখন বুঁদ মোবাইলে।
এর পরে বিশেষ স্কুল, বিশেষ শিক্ষিকা, স্পিচথেরাপি, কোভিড-পর্ব পেরিয়ে শুরু হয় ২০২১ সাল। অরিন্দম জানান, সে বছর মার্চ থেকে ছেলের রোজ বিকেলে জ্বর আসা শুরু হল। শহরের কোনও শিশুরোগ চিকিৎসককে দেখাতে বাদ দেননি তাঁরা, কিন্তু কেউই ধরতে পারেননি। টানা এক বছর প্রতিদিন জ্বরভোগের পরে ২০২২ সালে এক দিন বাবার সঙ্গে বাজার থেকে ফিরে ঘরে পড়ে যায় অস্মিত। কোলে তুলে পিজিতে ছোটেন বাবা-জেঠা। দেখা যায়, তার রক্তে হিমোগ্লোবিন নেমেছে ৩.৩-এ, প্লেটলেট পাঁচ হাজার! ‘‘মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। তখনও জানতাম না, ওর ক্যানসার হয়েছে। এর পরে যোগাযোগ হয় হেমাটোঅঙ্কোলজিস্ট সাজিয়া গুলশনের সঙ্গে। উনি সঙ্গে সঙ্গে বোন ম্যারো পরীক্ষা করিয়ে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করেন।’’— বলছেন অরিন্দম।
সে সময়ে অস্মিতের মা-বাবার কাছে একমাত্র আশার আলো ছিলেন চিকিৎসক সাজিয়াই। অরুজার হাত ধরে অভয় দিয়েছিলেন তিনি। পাশে ছিলেন শিশুরোগ চিকিৎসক সংযুক্তা দে এবং পিয়ারলেস হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও। অরুজা জানান, আট মাস ধরে চলা কেমোথেরাপির জন্য প্রায় ৬ মাস হাসপাতালে ভর্তি ছিল অস্মিত। কেমোর পরে ২১ দিন গ্রিন ডায়েরিয়া হয়েছিল তার। ৬৭ ইউনিট রক্ত, ৪৭ ইউনিট প্লেটলেট, ১৫-১৬ ইউনিট প্লাজ়মা দিতে হয়েছিল তাকে। ‘‘রাতের পর রাত রক্তের প্যাকেটের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কেটে গিয়েছে। বন্ধুবান্ধব, পরিজনেরা অক্লান্ত ভাবে সাধ্যমতো ব্লাড কার্ড জুগিয়ে গিয়েছেন।’’— বলছেন অস্মিতের মা। চিকিৎসার বিপুল খরচের ভার কিছুটা লাঘব করতে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিল হাসপাতালও।
কতটা কঠিন ছিল এই লড়াই? সাজিয়া জানাচ্ছেন, অ্যাকিউট লিউকিমিয়া না সারার প্রবণতা বেশি থাকে। তবে অস্মিতের শরীরে আগে মাঝেমধ্যে স্টেরয়েড ঢুকেছিল বলেই হয়তো এক বছর যুঝতে পেরেছিল সে। যদিও রোগী অটিস্টিক হওয়ায় চিকিৎসা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং ছিল। ‘‘কেমোর পরে শারীরিক সমস্যা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া— এর কোনও কিছুই ও বুঝিয়ে বলতে পারত না। ফলে কোনও সমস্যা হলে তা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছে যেত।’’— বলেন সাজিয়া। অস্মিতের সঙ্গে ডাক্তার, হাসপাতালের কর্মীদের একটা মানসিক সম্পর্ক গড়ে ওঠায় অনেকটা সুবিধা হয়েছিল বলে মনে করেন শিশুরোগ চিকিৎসক সংযুক্তা। তাঁর মতে, ‘‘যে কোনও হাসপাতালে শিশুরোগীদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকটাতেও নজর দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ, সুস্থ করার জন্য তাকে মানসিক ভাবে সুস্থ রাখাটাও দরকার।’’
অন্ধকারময় সেই দিনগুলোয় অস্মিত অবশ্য বুঝতে পারত যে, ও অসুস্থ। তাই শত কষ্ট হলেও সয়ে নিয়েছে। আবার কখনও বাড়ি ফিরবে বলে হাসপাতাল মাথায় করেছে। সে সময়ে ওকে ভুলিয়ে রাখতে এগিয়ে আসতেন হাসপাতালের নার্স-আয়ারাই। এখন অবশ্য শুধু ওষুধ খাওয়ার পালাটুকুই চলছে। কয়েক মাসের মধ্যে সেই কোর্সও শেষ হবে। তার পরে নির্দিষ্ট সময় অন্তর পরীক্ষা করিয়ে যাওয়ার কথা। তবেই ‘ক্যানসারজয়ী’র তকমা পাবে অস্মিত।
সেই দিনের আশাতেই তাকিয়ে তার গোটা পরিবার।