অংশুপ্রতিম পাল, খড়গপুর: রাজ্য়ে ফের ভোটের ডঙ্কা। এবার ৬ বিধানসভায় উপনির্বাচন। তার মধ্যে রয়েছে মেদিনীপুরও। এবারের ভোটে বাজিমাত করবে কে? আর জি কর কাণ্ডকে হাতিয়ার করে রাজ্যের শাসকদলকে কোণঠাসা করতে পারবে বিরোধীরা না কি সেই ‘ক্ষত’য় তৃণমূলের মলম হবে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার? সাম্প্রতিক আন্দোলনকে হাতিয়ার করে একসময়ের শক্ত ঘাঁটি মেদিনীপুরে দাঁত ফোটাতে পারবে বামেরা? উত্তর খুঁজল সংবাদ প্রতিদিন ডট ইন।
মেদিনীপুরে উপনির্বাচন কেন?
রাজনীতির আঙিনায় পা রেখেই মেদিনীপুরের বিধায়ক পদে বসেছিলেন জুন মালিয়া। তাঁর উন্নয়ন ও সাংগঠনিক দক্ষতার উপর ভরসা রেখে চব্বিশের লোকসভায় প্রার্থী করেছিলেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জিতে আপাতত লোকসভায় তিনি। ফলে সেই শূন্যস্থান পূরণ করতেই এবার উপনির্বাচন।
বিধানসভার পরিচয়
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার এই বিধানসভায় শহরাঞ্চলের পাশাপাশি বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলও রয়েছে। এই বিধানসভায় রয়েছে-
মেদিনীপুর পুরসভার ২৫টি ওয়ার্ড
মেদিনীপুর সদর ব্লকের ৪টি গ্রাম পঞ্চায়েত-চাঁদরা, ভেরুয়া, কঙ্কাবতী, মণিদহ
শালবনি ব্লকের ৫টা গ্রাম পঞ্চায়েত- কর্ণগড়, গরমাল, সাতপাটি, কাশীজোড়া, পাখিবাঁধ
মোট ভোটার ২ লক্ষ ৯১ হাজার। শহরাঞ্চলের (মেদিনীপুর সদর ব্লক) ভোটার সংখ্যা ১ লক্ষ ৫১ হাজার। গ্রামাঞ্চলে রয়েছে ১ লক্ষ ৪০ হাজার ভোটার। পুরুষের তুলনায় মহিলা ভোটার বেশি। পরিসংখ্যান বলছে প্রতি ১ হাজার পুরুষ ভোটারে ১০৩২ জন মহিলা ভোটার। একদিকে শহরাঞ্চলের ভোটার বেশি, অন্যদিকে মহিলা ভোটারের সংখ্যাও বেশি। ফলে এই কেন্দ্রে আর জি করে জুনিয়র চিকিৎসকের ধর্ষণ-খুনের ঘটনা ভোটব্যাঙ্কে প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন রাজনীতির কারবারিরা।
বিধানসভার ইতিহাস
এই কেন্দ্রে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সিপিআই প্রার্থী জিতে এসেছেন। শেষবার জিতেছিলেন সিপিআই প্রার্থী পূর্ণেন্দু সেনগুপ্ত। তার পর ২০১১ এবং ২০১৬ সালে এই কেন্দ্রে জোড়াফুল ফুটিয়েছিলেন মৃগেন মাইতি। তার পর তাঁর মৃত্যু হয়। একুশের ভোটযুদ্ধে রুপালি পর্দার জনপ্রিয় অভিনেত্রী জুন মালিয়াকে প্রার্থী করে তৃণমূল। জিতেও যান তিনি। চব্বিশের লোকসভা ভোটে তাঁরই উপর বাজি রাখে তৃণমূল। বর্তমানে তিনি লোকসভার সাংসদ।
প্রার্থী পরিচয়
জুনের ছেড়ে যাওয়া আসনে এবার ঘাসফুল শিবিরেপ প্রার্থী সুজয় হাজরা। তৃণমূলের সাংগঠনিক জেলার সভাপতি। তথা বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক। সিএবির সঙ্গেও যুক্ত। তাঁকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বিজেপির হয়ে ভোটে লড়ছেন শুভজিৎ রায়। বাম শিবিরের সিপিআই প্রার্থী মণিকুন্তল খামরুই। কংগ্রেসের প্রার্থী শ্যামলকুমার ঘোষ। চার প্রার্থী ময়দানে থাকলেও লড়াই মূলত দ্বিমুখী।
রাজনৈতিক লড়াইয়ে এগিয়ে কে?
বামদুর্গ পতনের পর থেকে এই এলাকায় তৃণমূলের সংগঠন শক্তিশালী। পুর এলাকায় সংগঠন শক্তিশালী হলেও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের চোরাস্রোত বইছে। একদিকে রয়েছে জুন মালিয়া গোষ্ঠী, অন্যদিকে সুজয় হাজরা গোষ্ঠী। মালিয়া-গোষ্ঠীর সঙ্গে রয়েছেন পুরপ্রধান সৌমেন খান। উলটোদিকে রয়েছেন জেলার সহ সভাপতি বিশ্বনাথ পাণ্ডব। রাজনীতিবিদরা বলছেন, গত লোকসভা নির্বাচন দলীয় প্রচারে বিশ্বনাথ পাণ্ডবকে সক্রিয় হতে দেখা যায়নি। এবার তাঁর সহযোদ্ধা সুজয় হাজরা প্রার্থী হওয়ায় প্রথম দিন থেকে সক্রিয় বিশ্বনাথ। প্রচারে বড় ভূমিকা নিয়েছেন প্রার্থীর স্ত্রী মৌসুমী হাজরা। তিনিও তৃণমূল কাউন্সিলর। ভোটপ্রচার করছেন বাড়ি-বাড়ি গিয়ে। স্বামীর জন্য নয়, দলের জন্য ভোট চাইছেন।
চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনে মেদিনীপুর পুর এলাকায় পিছিয়ে পড়েছিল তৃণমূল। সেই দুর্বলতা ঢেকে দিয়েছিল গ্রামাঞ্চল। ফলে বিজেপি ও তৃণমূল প্রার্থীর মধ্যে ভোটের ব্যবধান ছিল মোটে ২২০০। উপনির্বাচনে এই ঘাটতি মিটিয়ে ফেলা যাবে বলে আশাবাদী বিজেপি। গেরুয়া শিবিরকে ভরসা জোগাচ্ছে দুটি বিষয়, এক-তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, দুই-আর জি কর কাণ্ড। তাদের অনুমান, আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মহিলা চিকিৎসকের ধর্ষণ খুনের ঘটনার প্রভাব পড়বে শহরাঞ্চলের মহিলা ভোটারদের উপর। পালটা লোকসভা ভোট থেকে আরও ফল ভালো হবে আশাবাদী তৃণমূলও। তাদের আশা, ভোট ব্য়বধান বেড়ে হবে ৫০ হাজার। কারণ, মানস ভুঁইয়ার তদারকিতে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে প্রলেপ পড়েছে। শেষদিকে দ্বন্দ্ব উড়িয়ে প্রচারে নেমেছেন সাংসদ জুন মালিয়াও। ফলে ‘নিষ্ক্রিয়’ কর্মীরাও সক্রিয় হয়েছেন। ঘাসফুল শিবির আত্মবিশ্বাসী, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার-সহ রাজ্য সরকাকে সামাজিক কল্যাণমূলক একাধিক প্রকল্পের কল্যাণে মহিলা ভোটব্যাঙ্ক কেন্দ্রীভূত হবে। কারণ আর জি কর কাণ্ডের একেবারে প্রভাব নেই গ্রামাঞ্চলে। বরং প্রভাব পড়েছে শহরের মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তের উপর। তবে তা ভোটব্যাঙ্কে বিশেষ প্রভাব ফেলতে পারবে না বলেই মনে করছে তৃণমূল। সুবিধা করতে পারবে না বিরোধীরা।
আর জি কর আন্দোলন বামেদের কিছুটা অক্সিজেন জোগাতে পারলেও মেদিনীপুরে ছন্নছাড়া তারা। একেবারেই প্রচারে নেই। সংগঠন কার্যত ধ্বংসস্তূপ। মানুষের পৌঁছনোর ক্ষমতা নেই। কংগ্রেসের প্রার্থী ভোটে নেমেছেন বটে তবে তাঁর জামানত বাজেয়াপ্ত হবে বলেই আশঙ্কা। তাই মেদিনীপুরের ভূমিতে চার দলের অস্তিত্ব থাকলেও লড়াই মূলত দুই ফুলের। সেখানে কে বাজিমাত করে, সেটাই এখন দেখার।