চৈতন্যদেবের পদধূলি ধন্য ইতিহাস বিজড়িত বেলদার ময়নাপাড়ার রাস
বর্তমান | ১৩ নভেম্বর ২০২৪
সৌম্যকান্তি ত্রিপাঠী, বেলদা: প্রায় পাঁচশো বছর আগে চৈতন্য মহাপ্রভু এসেছিলেন বেলদা থানার ময়নাপাড়ায়। কথিত আছে তিনি এখানে একটি রাত কাটিয়েছিলেন। বৈষ্ণবদের গ্রন্থে উল্লেখ আছে চৈতন্যদেবের পুরীধাম গমনের ইতিবৃত্ত। কথিত আছে, ১৫১০ সাল নাগাদ যাত্রাকালে বেলদা থানার ময়নাপাড়া মৌজায় বিশাল বটগাছের তলায় তিনি রাত কাটান। সেই কাহিনীকে ঘিরেই প্রতি বছর রাস উৎসব হয়। গড়ে তোলা হয়েছে তাঁর বিগ্রহ। জানা গিয়েছে, চৈতন্যদেব সপার্ষদ পথের ক্লান্তি দূর করতে বড় দিঘির পাড়ে ময়নাপাড়ায় উপস্থিত হন। তাই বৈষ্ণব গ্রন্থে জায়গাটি ‹বিশ্রামতলা› নামে উল্লেখ রয়েছে। পরদিন সকালে দাঁতনের পথ ধরে নীলাচল তথা পুরীর দিকে যাত্রা করেন।
কথিত আছে পুরী যাওয়ার পরই একদিন নন্দ দাস নামে একজন ভক্ত স্বপ্নাদিষ্ট হন। তিনি নিজে চৈতন্যদেবের মূর্তি গড়ে পুজো শুরু করেন। পরে এলাকার জমিদাররা সেই পুজো করতেন। সেই থেকেই নানা উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে চলে আসছে রাস উৎসব। বিখ্যাত হয়ে উঠেছে মহাপ্রভুর বিগ্রহও। গড়ে উঠেছে মন্দির। তবে সেই বটগাছ আর নেই। ওই গাছের শেকড় থেকে নতুন একটি গাছ লাগানো হয়েছে। রাস উৎসবের সময় মাটির মূর্তি গড়ে চৈতন্যদেবের বিগ্রহ বটতলায় রেখে পূজার্চনাও করা হয়। সেই ঐতিহ্য বজায় রেখে আজও প্রতিবছর কার্তিক মাসের একাদশী থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত চলে রাস উৎসব। গত ১২ নভেম্বর একাদশী তিথি থেকে শুরু হয়েছে উৎসব। নগর সংকীর্তন ও নগর পরিক্রমা করে শুরু হয় এই রাস উৎসব। মহা সমারোহে ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পাঁচ দিন চলে প্রায় দেড়শো বছর ধরে হয়ে আসা এই রাস মেলা।
প্রতিদিন দুপুর ও রাতে থাকে বসে খাওয়া ও বাড়িতে কুঁড়ি প্রসাদ নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা। ময়নাপাড়া রাস উৎসব কমিটি এই আয়োজন করে থাকেন। ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড সহ এই রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্তরা ভিড় জমান একাদশী থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত।
নারায়ণগড় ব্লকের বেলদা থেকে দাঁতন যাওয়ার রাস্তায় শুশিন্দা রেলগেট পড়বে। ওই গেট পেরিয়ে রাজ্য সড়ক থেকে পিচ রাস্তা ধরে মাত্র এক কিলোমিটার গেলেই ময়নাপাড়া। কথিত আছে এই পথ ধরেই চৈতন্যদেব পুরীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন। মাঝে দাঁতনের কাকরাজিতেও থেমে ছিলেন। সেখানেও মন্দির ও বিগ্রহ আছে। রাস উৎসবও হয়।
কীর্তন, যাত্রা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সহ দুঃস্থদের বস্ত্র দানের মতো আয়োজন করে এই রাস উৎসব কমিটি। ঐতিহ্য মেনে সন্ধ্যায় ময়নাপাড়ায় মন্দির থেকে বেরিয়ে মহাপ্রভু ভক্তদের মাঝে উপস্থিত হন। প্রধান সেবাইতের কাঁধে চড়ে খোল কীর্তনের তালে মহাপ্রভুর নাচ এখানে বিশেষ আকর্ষণ। এখানে। বহু মানুষ উপভোগ করেন মহাপ্রভুর এই নৃত্য।
রাস উৎসব কমিটির অন্যতম চঞ্চল দাস, দুলাল দাস, শক্তিপদ জানা বলেন, ‘আমাদের ময়নাপাড়ার রাস মানেই একটা ইতিহাস। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বটতলায় বসে পথের ক্লান্তি নিরসনের সেই কাহিনি আমরা বংশপরম্পরায় শুনে আসছি। আমরা রাস উৎসব কমিটি সেই ইতিহাসকে ধরে রাখতে প্রতিবছর এই উৎসবের আয়োজন করে আসছি। ভক্তদের সহযোগিতায় তৈরি করা চলছে, নতুন মন্দির। ইতিহাস বিজড়িত এই স্থানকে হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করার জন্য আমরা রাজ্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।’