লোকসভা ভোটে বিপর্যয়ের পর এমনিতে বিজেপির পরিস্থিতি রাজ্যের নিরিখে খুব ‘অনুকূল’ নয়। রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার কেন্দ্রে মন্ত্রী হয়ে যাওয়ার পরে পরবর্তী সভাপতি কে হবেন, তা নিয়েও বিবিধ জল্পনা রয়েছে। দলের এক নেতার কথায়, ‘‘ক্যামেরার যেমন ট্রাইপড হয়, তেমনই আমাদের দলেরও ট্রাইপড (শুভেন্দু অধিকারী, সুকান্ত মজুমদার, দিলীপ ঘোষ) ছিল। কিন্তু একটা পা অন্য দুটোর চেয়ে বেশি শক্তি শালী হয়ে যাওয়ায় ক্যামেরার ফোকাসে গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। তাই ছবি ভাল উঠছে না।’’ নাম না করলেও ওই নেতা যে শুভেন্দুকে বোঝাতে চেয়েছেন, তা স্পষ্ট। এই পরিস্থিতিতে হিমন্তকে নিয়ে জল্পনা শুরু হওয়া ‘অস্বাভাবিক’ নয় বলেই অনেকে মনে করছেন। আবার অনেকের মতে, কেউ ‘খোঁজখবর’ নিলেই যে তিনি সেই রাজ্যের ‘দায়িত্ব’ পাবেন, তা নয়। এটা খানিকটা ‘অতি সরলীকরণ’ হয়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিক কৌতূহলেই হিমন্ত পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে থাকতে পারেন।
ঝাড়খণ্ডের নির্বাচন ঘোষণা হওয়ার আগেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহানকে মাথায় বসিয়ে হিমন্ত ও পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দুকে ওই ভোট পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছিল বিজেপি। দায়িত্ব পাওয়ার পরেই ওই তিন নেতা পালা করে ঝাড়খণ্ডে গিয়েছেন।
নির্বাচন ঘোষণা হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের নেতাদের গতিবিধি বেড়েছে ঝাড়খণ্ডের রাজনীতিতে। সেখানেই পশ্চিমবঙ্গ থেকে ঝাড়খণ্ডের ভোটে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের সঙ্গে কয়েক বার বৈঠক করেছেন হিমন্ত। তাঁদের মধ্যে যেমন রয়েছেন শুভেন্দু, তেমনই রয়েছেন বঙ্গ বিজেপির সাধারণ সম্পাদক তথা বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পাল এবং দার্জিলিংয়ের সাংসদ রাজু বিস্তা। জঙ্গলমহলের বিজেপি বিধায়কেরা যখন ঝাড়খণ্ডে ভোটের প্রচারে গিয়েছেন, তখন তাঁদের সঙ্গেও পশ্চিমবঙ্গ সংগঠন প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন অসমের মুখ্যমন্ত্রী। জানতে চেয়েছেন, বিজেপির সংগঠন কেন বাংলায় সে ভাবে দানা বাঁধছে না। বা গত বিধানসভা ও লোকসভা নির্বাচনে কেন বিজেপির ভোট শতাংশ ৩৮ শতাংশ থেকে বাড়ানো যায়নি।
২০১৯ সালের লোকসভা এবং ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনেও পশ্চিমবঙ্গে এসে কাজ করেছিলেন হিমন্ত। কিন্তু এ বারে তিনি অনেক বেশি সংগঠন নিয়ে খোঁজখবর নিচ্ছেন বলে মনে করছেন নেতা-নেত্রীরা। সেই সূত্রেই বঙ্গ বিজেপির নতুন সভাপতি থেকে শুরু করে ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তাঁর ‘ভূমিকা’ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। সাংগঠনিক এবং প্রশাসনিক দক্ষতার কারণে নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহের ‘আস্থাভাজন’ হিমন্ত। তাঁর নেতৃত্বে অসম তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজনীতিতে বিজেপির প্রভাব যে বেড়েছে, তা অস্বীকার করেন না বিজেপির শীর্ষনেতারা। সেই সূত্রেই বাংলায় বিধানসভা নির্বাচনের দেড় বছর আগে থেকে রাজ্যের রাজনীতি নিয়ে হিমন্তের ‘আগ্রহ’ নতুন জল্পনা উস্কে দিচ্ছে।
বাংলায় ভাল ফলাফলের জন্য বিজেপি অনেক সময়েই কেন্দ্রীয় নেতাদের উপর নির্ভর করেছে। ২০১৯ সালে যেমন ছিলেন কৈলাস বিজয়বর্গীয়, তেমনই ২০২৪ সালে ছিলেন সুনীল বনশল। কিন্তু ভোটের ফলাফল বলছে, বনশল ব্যর্থ হয়েছেন। ২০১৯ সালের তুলনায় বিজেপি ২০২৪ সালে সাতটি আসন কম পেয়েছে। এর পরেও ২০২৬ সালে বনশলকে ভোটের দায়িত্বে রাখা হবে কি না, তা নিয়ে অনেকে সন্দিহান। সেই সূত্রেই হিমন্তের নাম নিয়ে আলোচনা আরও ইন্ধন পাচ্ছে।
অনেকেই হিমন্তের ‘বিচক্ষণতা’র উপর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের আস্থার উদাহরণ দিতে গিয়ে ২০২২ সালের উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনের কথা বলছেন। ওই নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমর্থন আদায়ের জন্য হিমন্তকেই দায়িত্ব দিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতৃত্ব। বাংলার তৎকালীন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়কে বিজেপি এনডিএ শিবিরের প্রার্থী করেছিল। অসমের মুখ্যমন্ত্রী ওই দায়িত্ব পেয়েই যোগাযোগ করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দুর সঙ্গে। দলীয় সিদ্ধান্ত তাঁকে জানিয়ে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের কোথায় গিয়ে আলোচনা সম্ভব, সেই পরামর্শও চেয়েছিলেন হিমন্ত।
সূত্রের খবর, শুভেন্দু পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপির রাজনৈতিক সমীকরণ বুঝিয়ে কলকাতা থেকে দূরে কোথাও বৈঠক করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। শুভেন্দু অসমের মুখ্যমন্ত্রীকে বলেছিলেন, ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের পরে শাসক তৃণমূলের ‘সন্ত্রাস’-এর শিকার হয়েছেন বিজেপির নেতা-কর্মীরা। সেই পটভূমিতে কলকাতায় এসে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গে বৈঠক করলে তা ‘ভুল’ বার্তা বহন করবে। তাই বৈঠক হোক উত্তরবঙ্গের কোথাও। সেই বৈঠকে যেন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালও উপস্থিত থাকেন।
তার পরেই দার্জিলিঙে একান্তে বৈঠক করেন হিমন্ত-মমতা। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ধনখড়ও। দেখা যায়, উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তৃণমূল সাংসদেরা ভোটদানে বিরত রয়েছেন। তাঁরা ধনখড়ের সমর্থনে ভোট না দিলেও ধনখড়ের বিরুদ্ধেও ভোট দেননি। মনে করা হয়, হিমন্তের সঙ্গে দার্জিলিঙের আলোচনায় ওই ‘কৌশলগত’ অবস্থান ঠিক হয়েছিল।