একটা সময়ে গুরুংয়ের গোর্খা জনমুক্তি মোর্চাতেই ছিলেন অনীত। কিন্তু ক্ষমতার বলে গুরুং যখন পাহাড়ে একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করেন, তখন তাঁর সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন অনীত এবং বিনয়। পরে অনীত-বিনয় পুরনো দল ছেড়ে বেরিয়ে তৈরি করেন ভারতীয় গোর্খা প্রজাতান্ত্রিক মোর্চা। সেই দল থেকে আবার বিনয় বেরিয়ে যোগ দেন তৃণমূলে। সেই থেকে দলের সর্বেসর্বা অনীতই। তাঁর ক্ষমতা আরও বাড়িয়ে দিলেন মমতা।
লেপচা, ভুটিয়া-সহ পাহাড়ের জনজাতি অংশের জন্য আলাদা আলাদা করে ১৬টি উন্নয়ন বোর্ড গড়েছিল রাজ্য সরকার। ওই বোর্ডগুলি স্বাধীন ভাবে তাদের কাজ করত। সেই বাবদে বিভিন্ন দফতর থেকে অর্থ পেত। সেই অর্থ খরচ করত বোর্ডগুলিই। কিন্তু এ বার থেকে তা আর হবে না। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, ওই বোর্ডগুলির কাজ পরিচালনা করবে একটি তদারকি কমিটি। সেই কমিটিরও মাথায় থাকবেন অনীত। ওই কমিটিগুলি যে অর্থ পাবে বা খরচ করবে, তা তাদের অডিট করাতে হবে। সে দিক থেকে অনীতের হাতে আর্থিক বিষয়ও দেখভালের সুযোগ রইল।
এই ভাঙাগড়ার প্রক্রিয়া নিজেই করেছেন মমতা। প্রশাসনিক সূত্রে খবর, এ ব্যাপারে আর কাউকে তিনি ‘নাক গলাতে’ দেননি। হতে পারে সে কারণেই উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী উদয়ন গুহ বলেছেন, ‘‘ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই মুখ্যমন্ত্রী যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার নিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করার জায়গায় আমি নেই।’’ মমতা রাজনৈতিক ভাবেও ঘোষণা করে দিয়েছেন যে, অনীতের দলের পাশে তৃণমূল থাকবে।
ক্ষমতায় আসার পরে মমতার সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল জঙ্গলমহল এবং পাহাড় ‘ঠান্ডা’ করা। জঙ্গলমহলের ক্ষেত্রে সাফল্য পেলেও পাহাড়ের ক্ষেত্রে নানা ধরনের বিড়ম্বনার মুখোমুখি হতে হয়েছে রাজ্য সরকারকে। গুরুংয়ের মতো নেতার হাতে ক্ষমতা দেওয়ার পর গোড়ায় সব ঠিকঠাক থাকলেও পরে সমস্যা তৈরি হয়। যে কারণে গুরুংয়ের ক্ষমতা খর্ব করার পথে হাঁটতে হয়েছিল। যদিও তাঁর পাল্টা মুখ হিসাবে বিনয়কে তুলে ধরা নিয়ে রাজনৈতিক মহলের অনেকে বলেছিলেন, ‘‘বিড়ালকে বাঘ সাজানো হচ্ছে।’’ পরবর্তী কালে দেখা যায়, বিনয় নিজের পায়ে পাহাড়ে দাঁড়াতে না পেরে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু তত দিনে পাহাড়ের রাজনীতিতে অনীতের উত্থান হয়ে গিয়েছে। পুর নির্বাচনে হামরো পার্টির অজয় এডওয়ার্ডের প্রাথমিক সাফল্য দেখে প্রশাসনের অনেকে শঙ্কিত হয়েছিলেন যে, ফের পাহাড়ে নতুন আকচাআকচি শুরু হতে চলেছে। যদিও এখনও পর্যন্ত যা ছবি, তাতে হামরো পার্টির ওই জয়কে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলেই মনে করছেন পাহাড়বাসী। পরবর্তী কালে অজয়ও কংগ্রেসের দিকে ঘেঁষেছিলেন। তবে বিশেষ কিছু করে উঠতে পারেননি।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে শেষ বার পাহাড়ে আগুন জ্বলেছিল। দীর্ঘ দিন ধরে চলা সেই আন্দোলন যে অর্থনীতিতে ধাক্কা দিয়েছিল, তা মানেন পাহাড়ের নেতারা। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই কোভিডের ধাক্কা আবার ‘পঙ্গু’ করে দিয়েছিল পাহাড়ের অর্থনীতি এবং জনজীবনকে। যার অনেকটাই নির্ভরশীল পর্যটনের উপর। এ কথা ঠিক যে, পাহাড়কে স্বাভাবিক ছন্দে রাখতে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মমতা যে ‘ধারাবাহিকতা’ দেখিয়েছেন, অতীতে কোনও মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষেত্রেই তা দেখা যায়নি। নিয়মিত পাহাড়ে যাওয়া, বৈঠক করা ইত্যাদির ফলে রাজনৈতিক ভাবে না হলেও মমতা প্রশাসনিক ভাবে সেখানকার মানুষের আস্থা অর্জন করতে পেরেছেন বলে অভিমত শাসক শিবিরের। তবে একই সঙ্গে শাসকদলের নেতারা এ-ও মানেন যে, পাহাড়ে তৃণমূল এখনও ‘রাজনৈতিক আস্থা’ অর্জন সে ভাবে করতে পারেনি। মমতা মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে যত বার পাহাড়ে গিয়েছেন, তা তাঁর পূর্বসূরি কোনও মুখ্যমন্ত্রী করেননি। এক প্রশাসনিক আধিকারিকের কথায়, ‘‘প্রশাসনের মূল উদ্দেশ্য পাহাড়কে স্বাভাবিক রাখা। সেখানে যাতে বিচ্ছিন্নতাবাদ মাথা না তোলে সে দিকে লক্ষ্য রাখা। তার জন্য প্রশাসনিক গতিশীলতা জরুরি। মুখ্যমন্ত্রী সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই যা করার করেছেন।’’
তবে অনীতের ক্ষমতা যে ভাবে বৃদ্ধি পেল, তাতে পাহাড়ের মাটিতে নতুন করে কোনও ‘আধিপত্যবাদী’ মানসিকতার বীজ রোপিত হল কি না, সেই আলোচনাও রয়েছে উত্তরবঙ্গের রাজনীতিতে। কারণ, সকলেই মানছেন, রাজ্যের নিরিখে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হলেও পাহাড়ে রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হল অনীতের হাতেই।