• সুশান্তের তিন আততায়ীর আস্তানার ব্যবস্থা করে দেন তাঁরই ‘ঘনিষ্ঠ’? জটিলতায় ঘুরপাক খাচ্ছে কসবাকাণ্ড
    আনন্দবাজার | ১৭ নভেম্বর ২০২৪
  • কসবার তৃণমূল কাউন্সিলর সুশান্ত ঘোষকে গুলি করে খুনের চেষ্টার ঘটনায় উঠে এসেছে তিন বন্দুকবাজের কথা। সেই তিন আততায়ীকে কলকাতায় থাকার বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন সুশান্তেরই ঘনিষ্ঠ এক ব্যবসায়ী! তদন্তকারীদের সূত্রে খবর, সুশান্ত-ঘনিষ্ঠ ওই ব্যবসায়ী শুক্রবারের গুলিকাণ্ডের ‘মূল ষড়যন্ত্রকারী’ আফরোজ় খান ওরফে গুলজ়ারেরও ‘ঘনিষ্ঠ’! তা হলে কি সুশান্তকে খুন করার পরিকল্পনার সঙ্গে ছিলেন তাঁরই পরিচিত ওই ব্যবসায়ী? যদিও তাঁর দাবি, কাউন্সিলরকে খুনের পরিকল্পনার ব্যাপারে বিন্দুবিসর্গ জানতেন না তিনি। সব মিলিয়ে এক গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খাচ্ছেন তদন্তকারীরা।

    শুক্রবার সন্ধ্যায় কসবায় নিজের বাড়ির সামনে বসে ছিলেন কলকাতা পুরসভার ১০৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সুশান্ত। সেই সময় আচমকাই স্কুটারে চেপে আসেন দু’জন। তাঁদের মধ্যে এক জন স্কুটার থেকে নেমে এসে একেবারে সুশান্তের সামনে পৌঁছে তাঁকে লক্ষ্য করে পর পর দু’বার গুলি চালানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু দু’বারই ব্যর্থ হন। ফের স্কুটারে চেপে পালানোর সময় এক আততায়ীকে ধরে ফেলেন সুশান্ত এবং তাঁর সঙ্গীরা। ধৃতের নাম যুবরাজ সিংহ।

    তদন্তে নেমে পুলিশ এখনও পর্যন্ত বেশ কয়েকটি সূত্র পেয়েছে। সেই সূত্র ধরেই শনিবার ‘মূল ষড়যন্ত্রকারী’ আফরোজ়কে গ্রেফতার করে পুলিশ। তদন্তে উঠে আসে সুশান্ত পরিচিত ওই ব্যবসায়ীর নাম। আফরোজ়ের পরিচিত ওই ব্যবয়ায়ীই তিন আততায়ীকে থাকার জন্য লেককাউটনের কাছে কালিন্দিতে একটি ফ্ল্যাটের বন্দোবস্ত করেন। ওই ব্যবয়ায়ীর পরিচিত এক জনের ফ্ল্যাটেই ওঠেন তিন জন। পুলিশ ইতিমধ্যেই ওই ব্যবসায়ী এবং কালিন্দির ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের জেরা করেছে।

    তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন, সুশান্ত-পরিচিত ওই ব্যবসায়ীর সঙ্গে আফরোজ়ের সম্পর্ক খুবই ভাল। তাঁর কথাতেই লেকটাউনে ফ্ল্যাট ঠিক করে দেন তিনি। তবে সুশান্তকে খুন করার যে পরিকল্পনা হচ্ছে, সে সম্পর্কে ঘুণাক্ষরে জানতেন না বলে পুলিশকে জানিয়েছেন ওই ব্যবসায়ী। তাঁর বয়ান অনুযায়ী, আফরোজ় তাঁকে বলেছিলেন, বিহার থেকে তাঁর পরিচিতেরা আসছেন চোখের ডাক্তার দেখাতে। সেই জন্য একটা থাকার জায়গা ঠিক করে দিতে হবে। সেই মতোই লেকটাউনের কাছে ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করেছিলেন ওই ব্যবসায়ী।

    শুক্রবার রাত থেকে দফায় দফায় জেরা চলছে বন্দুকবাজ যুবরাজের। জেরার মুখে খুনের পরিকল্পনার কথা স্বীকার করেছেন তিনি। তদন্তকারীদের একাংশের সূত্রে খবর, বৃহস্পতিবার বিহার থেকে কলকাতায় আসেন যুবরাজ এবং তাঁর সঙ্গী। তার পর ফেরিতে গঙ্গা পেরিয়ে দু’জনে পৌঁছে যান বাবুঘাট। সেখানেই তাঁদের জন্য ট্যাক্সি নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন আহমেদ খান। সেই ট্যাক্সিচালককেও গ্রেফতার করেছে পুলিশ। আহমেদের ট্যাক্সির বন্দোবস্ত করেছিলেন আফরোজ়ই। বাবুঘাট থেকে যুবরাজদের নিয়ে লেকটাউনের ফ্ল্যাটে যান আহমেদ। বৃহস্পতি রাত এবং শুক্রবার সারা দিন সেখানেই ছিলেন যুবরাজেরা।

    তদন্তকারীদের একাংশের সূত্রে খবর, সুশান্তকে গুলি করে খুন করার জন্য তিন বন্দুকবাজকে ঠিক করা হয়েছিল। তবে এই তিন জনের মধ্যে এক জন বেশ কয়েক দিন আগেই কলকাতায় আসেন। শহরের কোথায় উঠেছিলেন, তা এখনও জানা যায়নি। বিগত কয়েক দিন ধরে সুশান্তের গতিবিধির উপর নজর রেখেছিলেন তিনিই। কখন, কোথায় যান, কার কার সঙ্গে দেখা করেন— সবটাই ছক কষেছিলেন। বৃহস্পতিবার রাতে লেকটাউনের ওই ফ্ল্যাটে অন্য দুই বন্দুকবাজের সঙ্গে দেখা করেন তৃতীয় আততায়ী। তদন্তে আরও জানা গিয়েছে, শুক্রবার হামলার আগে পার্ক সার্কাস এলাকায় আসেন ওই তিন জন। সেখানেই বাইক নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন আফরোজ়। ওই বাইকে চেপেই চার জন রওনা দেন কসবার দিকে। তবে মাঝে একটি ট্র্যাফিক সিগন্যালে বাইক দাঁড় করান আফরোজ়। সেখানেই নেমে যান যুবরাজ। ট্যাক্সিচালক আহমেদও ছিলেন সেই সিগন্যালে। যুবরাজের জন্য অন্য একটি স্কুটারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেই স্কুটারে চেপেই ঘটনাস্থলে পৌঁছন যুবরাজ। এখনও অধরা সেই স্কুটারচালক।

    শুক্রবার রাত থেকেই আফরোজ়ের গতিবিধি ছিল কলকাতা পুলিশের আতশকাচের নীচে। ‘পলাতক’ আফরোজ়কে খুঁজতে চারদিকে তল্লাশি শুরু করে পুলিশ। বিভিন্ন জায়গার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ খতিয়ে দেখা শুরু হয়। শনিবার হাওড়া পার হওয়ার সময়েই টোল প্লাজ়ার সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়েন আফরোজ়। দেখা যায় বাইক নিয়ে পালানোর চেষ্টা করছেন তিনি। আফরোজ়ের বাইকের নম্বর খুঁজে বার করে বর্ধমান পুলিশকে সতর্ক করে কলকাতা পুলিশের তদন্তকারী দল। বর্ধমান রেঞ্জের ডিআইজি ও পূর্ব বর্ধমানের পুলিশ সুপারের কাছে বার্তা পাঠানো হয়। সেই সতর্কবার্তা পাওয়ার পরেই পূর্ব বর্ধমানের পুলিশ সুপার সায়ক দাস ১৯ নম্বর জাতীয় সড়কে নাকা তল্লাশি করার নির্দেশ দেন থানাগুলিকে। নাকা চেকিংয়ের সময় গলসি থানার উড়োচটিতে আফরোজ়ের বাইকটি চিহ্নিত করে পুলিশ। তখনই বাইকটি থামানো হয়। আরোহীকে আটকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। জানা যায়, বাইক নিয়ে আফরোজ় বিহারের জামুইয়ে পালানোর চেষ্টা করছিলেন। সেখানেই তাঁর বাড়ি। এর পর তাঁকে পাকড়াও করে নিয়ে যাওয়া হয় গলসি থানায়। পরে কলকাতা পুলিশ তাঁকে নিজেদের হেফাজতে নেয়।

    উড়োচটিতে নাকা চেকিংয়ের সময় ধরা পড়া আফরোজ়কে গলসি থানায় আনা হয়। পুলিশ সূত্রে খবর, দক্ষিণ কলকাতার রুবি হাসপাতাল লাগোয়া আনন্দপুর এলাকার গুলশান কলোনিতে থাকেন আফরোজ়। সেখানে তাঁর জমি-বাড়ি রয়েছে। সেই জমি নিয়ে বিবাদ ছিল স্থানীয় এক জনের সঙ্গে। তিনি পেশায় প্রোমোটার। জেরায় পুলিশকে আফরোজ় জানিয়েছেন, ওই প্রোমোটার সুশান্তের অনুগামী। কাউন্সিলরের ‘ভয় দেখিয়ে’ সম্প্রতি তাঁর জমি দখল করে ফ্ল্যাট বানানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। তা মেনে নিতে পারেননি আফরোজ়। তখনই সুশান্তকে খুন করার পরিকল্পনা করেছিলেন বলে জেরায় পুলিশকে জানিয়েছেন তিনি। এমনটাই খবর পুলিশ সূত্রে। গলসি থানা থেকে বেরোনোর সময় তিনি বলেন, ‘‘সুশান্ত ঘোষ গুন্ডা হ্যায়! মেরা জায়গা দখল কিয়া হ্যায় তো মারা হ্যায় (আমার জায়গা দখল করেছিল, তাই মেরেছি)।’’

    বিহারের বাসিন্দা আফরোজ়। তবে বছর কয়েক ধরে সপরিবার কলকাতাতেই থাকেন তিনি। আনন্দপুর থানা এলাকাতেই তাঁর বাড়ি। সেখানে কিছু জমিজমাও রয়েছে। এলাকাবাসীর কাছে তিনি পরিচিত গুলজ়ার নামে। তবে তাঁর বাইক নথিভুক্ত করা আফরোজ় নামে। ধৃত ‘শুটার’ যুবরাজই আফরোজ়ের কথা পুলিশকে জানান। তবে যুবরাজের কাছে আবার তিনি ইকবাল নামে পরিচিত। ধৃত যুবরাজের কাছ থেকে আফরোজ় ওরফে গুলজ়ারের নাম জানার পরই তাঁর সম্পর্কে খোঁজখবর শুরু করেন তদন্তকারীরা। কোনও এক সূত্রে তদন্তকারীদের হাতে চলে আসে ইকবালের একটি ছবি। আনন্দপুর থানা এলাকায় তিনি থাকেন এমন খবরও পান তদন্তকারীরা। এলাকায় গিয়ে ‘ইকবাল’ নামে খোঁজখবর শুরু করেন তাঁরা। কিন্তু কেউই ‘ইকবাল’ নামের কাউকে চিনতে পারেননি। তবে ছবি দেখে প্রায় সকলেই তাঁকে ‘গুলজ়ার’ বলে চিনে ফেলেন। তদন্তকারীদের একটি সূত্রে খবর, স্থানীয়েরা কেউই স্পষ্ট করে বলতে পারেননি কী কাজ করতেন আফরোজ়। তবে সবাই জানান, ব্যবসা করেন তিনি। কিসের ব্যবসা? কেউ জানিয়েছেন, বালি-সিমেন্টের সিন্ডিকেটে যুক্ত। কেউ আবার জানান, চপ্পল তৈরির বাতিল দানা কিনে ব্যবসা করতেন। কারও কাছে তিনি আবার আলু ব্যবসায়ী! পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, আফরোজ়ের অপরাধের কোনও অতীত নেই। এমনকি, স্থানীয় কোনও অপরাধ গ্যাংয়ের সঙ্গেও জড়িত নন তিনি। কলকাতার বুকেই তাঁর আর একটি বাড়িরও খোঁজ মিলেছে।

    মাত্র ১০ হাজার টাকার জন্য সুশান্তকে খুনের চেষ্টা করেছিলেন আততায়ীরা। আর হাতে হাতে আড়াই হাজার টাকা পাবেন। ওই প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পর বিহার থেকে দুই সঙ্গীকে নিয়ে কলকাতায় আসেন যুবরাজ। তার পর পরিকল্পনামাফিক ঘটনাস্থলে পৌঁছন তিনি। পুলিশকে এমনই জানিয়েছেন ধৃত ‘শুটার’। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে তিনি আরও জানিয়েছেন, কাউন্সিলরকে ‘ভয় দেখানোর’ জন্য তাঁকে সুপারি দিয়েছিলেন ইকবাল (আফরোজ়)। তাঁর কাছ থেকে যে নাইন এমএম পিস্তলটি পেয়েছে পুলিশ, সেটিও ইকবালই তাঁকে দিয়েছিলেন।

    শনিবার যুবরাজকে আলিপুর আদালতে হাজির করানো হয়। শুধু তাঁকে একা নয়, সঙ্গে ধৃত ট্যাক্সিচালকও ছিলেন। আদালতে রাজ্যের পক্ষের আইনজীবী সৌরীন ঘোষালের সওয়াল, অভিযুক্ত বিহারের বৈশালী থেকে আসার পরই ‘লক্ষ্য’ ঠিক করে দেওয়া হয়। অভিযুক্ত ছাড়াও আরও লোক ছিল। তবে তাঁরা পালিয়েছেন। পুরো চক্রের খোঁজ চলছে। বৈশালীর আরও কয়েক জন এই ঘটনায় যুক্ত রয়েছেন। সুশান্তের আইনজীবী সুব্রত সরকার, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও আদালতে একই দাবি করেন। পাশাপাশি, তাঁরা আরও জানান, কেন এসেছিলেন, কে তাঁদের পাঠিয়েছিলেন, তা জানতে হবে। অভিযুক্ত যুবরাজের পক্ষের আইনজীবী জামিনের আবেদন করলেও তা খারিজ হয়ে যায়। সওয়াল–জবাব শেষে দুই অভিযুক্তকে ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক।

    শুক্রবার রাতের ঘটনার পরে সুশান্তের নিরাপত্তা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে কলকাতা পুলিশ। কাউন্সিলরের বাড়ির সামনে গার্ডরেল দেওয়া হয়েছে শনিবার। আগে সুশান্তের নিরাপত্তার জন্য কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের দুই নিরাপত্তারক্ষী ছিলেন। এ বার নিরাপত্তা দ্বিগুণ করছে পুলিশ। সুশান্ত জানিয়েছেন, তাঁকে খুনের চেষ্টার পর দলের শীর্ষ নেতৃত্ব উদ্বিগ্ন। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ফোন করে তাঁর খোঁজ নিয়েছেন। একে একে তৃণমূলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী, দক্ষিণ কলকাতা জেলা তৃণমূলের সভাপতি দেবাশিস কুমারের সঙ্গে কথা হয়েছে সুশান্তের। তাঁর সঙ্গে দেখা করেছেন কলকাতার মেয়র তথা পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম।

  • Link to this news (আনন্দবাজার)