• মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের পরই ‘অ্যাকশন’ শুরু করে দিল পুলিশ
    এই সময় | ২৩ নভেম্বর ২০২৪
  • এই সময়: বলেছিলেন ‘স্ট্রং অ্যাকশন’ নিতে। আর সেই নির্দেশের ২৪ ঘণ্টা কাটার আগেই শুরু হয়ে গেল ‘অ্যাকশন’!

    বৃহস্পতিবার নবান্নে সাংবাদিক বৈঠকে পুলিশের একাংশের ভূমিকা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমারকে বলেছিলেন ‘স্ট্রং অ্যাকশন’ নিতে। দুর্নীতিতে রাজনৈতিক রং না–দেখে নিদান দিয়েছিলেন প্রয়োজনে ‘কলার চেপে ধরার’। তার পরেই ফোর্সে সাসপেনশন থেকে শুরু করে রদবদল, এমনকী তৃণমূ‍ল নেতাদের গ্রেপ্তারি— বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার, পুলিশকে দেখা গিয়েছে রীতিমতো সক্রিয় ভূমিকায়।

    বৃহস্পতিবার রাতে আসানসোলের বারাবনি থানার ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক, সাব–ইনস্পেক্টর মনোরঞ্জন মণ্ডলকে সাসপেন্ড করা হয়। এই সিদ্ধান্তে রীতিমতো শোরগোল পড়ে যায় পুলিশমহলে। মনোরঞ্জনের সাসপেনশন নোটিসে বলা হয়েছে চাকরিতে ‘অপেশাদার আচরণ’ এবং ‘দায়িত্বে অবহেলার’ কথা। তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত শুরু হচ্ছে, জানানো হয়েছে তা–ও। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে মন্তব্য করা হয়েছে, ‘মনোরঞ্জন মণ্ডলকে চাকরিতে বহাল রাখা জনস্বার্থের পক্ষে ক্ষতিকারক।’ কিছু দিন আগেই বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী এক্স হ্যান্ডলে একটি ছবি পোস্ট করে দাবি করেছিলেন, বারাবনি থানার ওসি–র ঘরে কেক কেটে তৃণমূলের ব্লক সভাপতি অসিত সিংয়ের জন্মদিন পালন করা হয়েছে। সেই ছবিতে (সত্যতা যাচাই করেনি ‘এই সময়’) দেখা যাচ্ছে, ওসি নিজে কেক কেটে খাইয়ে দিচ্ছেন তৃণমূল নেতাকে। এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে।

    মনোরঞ্জনকে পদোন্নতি দিয়ে অন্ডাল থানার ওসি পদে বদলির জন্য গত ১৯ নভেম্বর যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, তা–ও এ দিন বাতিল করা হয়েছে। তাঁর বদলে অন্ডাল থানার ওসি হচ্ছেন জামুড়িয়া থানার শ্রীপুর পুলিশফাঁড়ির ইনচার্জ মেঘনাদ মণ্ডল, যিনি রানিগঞ্জে একা হাতে ডাকাতদের মোকাবিলা করে সম্প্রতি বিপুল প্রশংসা কুড়িয়েছেন। এ ছাড়া আসানসোল দক্ষিণ থানা এবং শ্রীপুর পুলিশফাঁড়ি থেকে দু’জন এসআই–কেও এ দিন বদলি করা হয়েছে।

    এ দিনই আবার কাঁকসা থানার ওসি পার্থ ঘোষকে ভবানী ভবনে কম্পালসরি ওয়েটিংয়ে পাঠানো হয়েছে। ৯ সেপ্টেম্বর কুলটির একটি কারখানায় দুই যুবককে পিটিয়ে মারার অভিযোগ উঠেছিল সিআইএসএফ–এর দুই কনস্টেবলের বিরুদ্ধে। সেই ঘটনায় এ দিন অভিযুক্ত দুই কনস্টেবল বি নরসিমহা রেড্ডি এবং কে জয়কৃষ্ণকে এ দিন গ্রেপ্তার করেছে কুলটি থানার পুলিশ।

    শুধু ফোর্সের ভিতরেই নয়, পুলিশের ‘অ্যাকশন’ এ দিন দেখা গিয়েছে রাজনীতির ময়দানেও। লোহা পাচারের অভিযোগে দুর্গাপুরের তৃণমূল কংগ্রেসের দুই নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ধৃতেরা হলেন অরবিন্দ নন্দী এবং রিন্টু পাঁজা। অরবিন্দ দুর্গাপুর পুরসভার ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের প্রাক্তন কাউন্সিলার, রিন্টু ৩ নম্বর ব্লকে দলের সহ–সভাপতি। বৃহস্পতিবার রাতেই দু’জনকে তলব করা হয় কোক ওভেন থানায়। সারা রাত বসিয়ে রাখার পরে ভোরে গ্রেপ্তার করা হয়।

    মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে বৃহস্পতিবার রাত থেকেই বালি, কয়লা, পাথর পাচার রুখতে জেলায় জেলায় শুরু হয়েছে পুলিশি অভিযান। বাড়ানো হয়েছে নাকা চেকিং। গুরুত্বপূর্ণ সড়কের উপরে বাস ও ট্রাক থামিয়ে তল্লাশি চলছে। তাঁর নির্দেশ উপেক্ষা করে রাজ্য থেকে আলু–পেঁয়াজ বাইরে পাঠানো নিয়ে বৃহস্পতিবার উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন মমতা। তার পরেই ডিজির–র নির্দেশে নাকা চেকিংয়ে এই দিকটিতে জোর দেওয়া হয়েছে। বাইরের রাজ্য থেকে এ রাজ্যে বেআইনি অস্ত্র এবং জাল নোট ঢোকা আটকাতে সীমানাবর্তী এলাকাগুলিতে বাড়ানো হয়েছে নজরদারি। বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বিহার ও ঝাড়খণ্ড থেকে আসা বাস–ট্রাকে। সাংবাদিক বৈঠকে সিআইডি–র ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে মুখ্যমন্ত্রী ‘রিশাফ্‌ল’–এর কথা বলেছিলেন। সূত্রের খবর, এ দিন সিআইডি–রও সক্রিয়তা বেড়েছে। গতি এসেছে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে গঠিত টাস্ক ফোর্সের কাজে।

    মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ কার্যকর করতে এ দিন সকালে বিভিন্ন জেলার এসপি এবং অন্য পুলিশকর্তাদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেন রাজীব কুমার। সূত্রের খবর, সেই ভার্চুয়াল বৈঠকে ডিজি সাফ জানিয়ে দেন, প্রত্যেক পুলিশকর্মীকে নিয়মশৃঙ্খলা মানতে হবে, রক্ষা করতে হবে উর্দির মর্যাদা। রাজীব এ–ও পরিষ্কার করে দিয়েছেন, কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গে তদন্ত হবে এবং অভিযোগ প্রমাণিত হলে কাউকে রেয়াত করা হবে না। বাঁকুড়া, বীরভূম, পুরুলিয়ার মতো যে সব জেলায় বালি ও পাথরখাদান রয়েছে, সেখানে নজরদারি আরও বাড়াতে বলেছেন ডিজি। সেখানকার পরিস্থিতি নিয়ে সবিস্তার রিপোর্টও চেয়েছেন।

    নজরদারি বাড়ানোর ফলও মিলতে শুরু করেছে হাতেনাতে। এ দিন বালি ভর্তি তিনটি লরি এবং ১৬ চাকার একটি ডাম্পার আটক করে আরামবাগ থানার পুলিশ। জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, আরামবাগ–কলকাতা রাজ্য সড়কের উপরে নাকা চেকিংয়ের সময়ে গাড়িগুলি ধরা হয়। সেগুলির কাছে কোনও চালান ছিল না। ছিল ওভারলোডেডও। আরামবাগের এসডিপিও সুপ্রভাত চক্রবর্তী বলেন, ‘এখন থেকে নিয়মিত নাকা চেকিং চলবে। বৈধ কাগজপত্র না–থাকলে কোনও বালি বা পাথরের গাড়ি ছাড়া হবে না।’

    অন্য দিকে, বালি ও কয়লা পাচার এবং অবৈধ খনন ঠেকাতে নির্দেশিকা জারি করেছে পূর্ব বর্ধমান জেলা প্রশাসন। জেলা ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দপ্তরের অতিরিক্ত জেলাশাসক বিশ্বরঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের সই করা নির্দেশনামায় বলা হয়েছে— জেলা, মহকুমা ও ব্লকস্তরের ভূমি ও ভূমি সংস্কার দপ্তরের সমস্ত আধিকারিকদের নিয়মিত নজরদারি চালাতে হবে। থানা পদক্ষেপ না–করলে সরাসরি এসপি–কে লিখিত অভিযোগ জানানো হবে। সেই চিঠির প্রতিলিপি পাঠানো হবে রাজ্য পুলিশের ডিজি–র কাছেও।

    পুলিশের এই সক্রিয়তা প্রসঙ্গে শুভেন্দু অধিকারী বলেন, ‘পুলিশকে ধমক দেওয়া হচ্ছে যাতে তারা ২০২৬–এর নির্বাচনে পার্টির ক্যাডারের মতো কাজ করে।’ আর সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তীর মন্তব্য, ‘কয়লা ধুলেই কি ময়লা যায়? দু’একজনকে সাসপেন্ড করে বাকিদের বাঁচানোর চেষ্টা চলছে।’
  • Link to this news (এই সময়)