• কলকাতার কড়চা: আত্মপ্রকাশের শতবর্ষ
    আনন্দবাজার | ২৩ নভেম্বর ২০২৪
  • বইপাড়ার অগণিত দোকানের মাঝে ‘খাদি প্রতিষ্ঠান’ নামের ছোট্ট বিপণি। হঠাৎ চোখ পড়লেও আজকের পথচলতি মানুষ হয়তো দু’বার তাকাবেন না, এমন কতই তো আছে শহর জুড়ে! তবে তলিয়ে দেখলে জানা যাবে একশো বছরের সমৃদ্ধ এক ইতিহাস। ১৯০২ সালের জানুয়ারিতে এই ১৫, কলেজ স্কোয়ার ঠিকানাতেই সাবেক অ্যালবার্ট হলে এক সভায় মহাত্মা গান্ধী কলকাতাবাসীকে শুনিয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয়দের উপর অবিচারের কথা। কলকাতা তথা বাংলায় তাঁর সেই প্রথম সভা, আয়োজক প্রফুল্লচন্দ্র রায়।

    তার দুই দশক পরে, ১৯২৩ সালের ২০ নভেম্বর এই বাড়িরই একতলায় এক চুক্তিপত্রে সই করেন প্রফুল্লচন্দ্র রায় রাজশেখর বসু সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত ও অমূল্যনাথ সেন, তাতে লেখা ছিল শহরের বিধবা ও অনাথদের সাহায্য-কর্মসূচি, খদ্দর ও চরকা প্রসারের লক্ষ্যে এক প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের কথা। সেই উদ্যোগই ‘খাদি প্রতিষ্ঠান’। ১৫ কলেজ স্কোয়ার ঠিকানা হল প্রধান কার্যালয়, কাজ শুরু হল ১৯২৪-এ, ট্রাস্টি ডিড পরের বছর জুনে। প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র সতীশচন্দ্রের প্রতিভার পরিচয় আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র পান এই গোলদিঘি চত্বর থেকেই, পরে তাঁকে নিয়োগ করেন বেঙ্গল কেমিক্যাল-এর মানিকতলা শাখায়। গান্ধীজির আদর্শ ও খাদির প্রচার-প্রসারে পূর্ণ সময় দিতে পরে বসবাসের বাংলো-সহ দেড় হাজার টাকার মাসমাইনের চাকরিও ছেড়ে দেন সতীশচন্দ্র। যোগ্য সঙ্গত করেন স্ত্রী হেমপ্রভা দেবী। তাঁর সামাজিক-অর্থনৈতিক কর্মসূচিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্রতে এই দম্পতির নিষ্ঠা ও ত্যাগের অকুণ্ঠ প্রশংসা করে গিয়েছেন স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী।

    কলেজ স্কোয়ারের মূল কেন্দ্র ছাড়াও একদা বাংলায় ছড়িয়ে থাকা ১২টি কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত খাদিবস্ত্র, লবণ, দেশলাই, কালি, ঘি, মধু, ওষুধের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় স্বদেশি দ্রব্য বিক্রির জন্য ছিল ২৫টি বিক্রয়কেন্দ্র। এই প্রতিষ্ঠান থেকেই ছাপা হয় বহু বই; সতীশচন্দ্রের লেখা কার্পাস শিল্প, কটন বইগুলি সরকার-বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য ব্রিটিশের কোপে পড়ে। সাম্প্রদায়িক হানাহানির সময় ত্রাণ বণ্টন ও পুনর্বাসন কাজেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল খাদি প্রতিষ্ঠানের। সবচেয়ে বড় কথা, দাঙ্গাবিধ্বস্ত নোয়াখালিতে গান্ধীজির ঐতিহাসিক পদযাত্রার আয়োজক ছিল এই প্রতিষ্ঠান। ১৯৪৯-এর নোয়াখালিতে বন্যাদুর্গতদের মধ্যে তাদের সেবাকাজের খবরও মেলে হেমপ্রভা দেবীকে উদ্দিষ্ট চিঠিতে (মাঝের ছবি)।

    ১৫ কলেজ স্কোয়ারের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটির শতবর্ষ এ বছর। তার উদ্‌যাপনে সেখানে গত ২০ নভেম্বর হল বিশেষ অনুষ্ঠান। কলেজ স্কোয়ার ও সোদপুরের খাদি প্রতিষ্ঠান (ছবিতে সেখানে গান্ধীজি, দরজায়), লবণ সত্যাগ্রহের স্মৃতিবহ মহিষবাথান, বেঙ্গল কেমিক্যাল মানিকতলা, সায়েন্স কলেজ ও বেলেঘাটা নিয়ে ঐতিহ্য-সফরের ভাবনাও আছে। স্মৃতি রোমন্থন ছাড়াও এক জরুরি কালখণ্ডের ইতিহাস-চর্চার প্রেরণা হতে পারে তা।

    ছত্রিশটি চিঠি। তার মধ্যে প্রথম পাঁচটি লেখা ‘ভাই ছোটবউ’কে, বাকি একত্রিশটির উদ্দিষ্ট ‘ভাই ছুটি’। ঠাকুরবাড়ির ছোটবৌ রবীন্দ্রনাথের দেওয়া নামে ‘মৃণালিনী’ হয়ে উঠেছিলেন বটে, কিন্তু চিঠিপত্র ছেয়ে ছিল কবির একান্ত নিজের ওই সম্বোধন, ‘ভাই ছুটি’। স্বামী-স্ত্রীর চিঠি দাম্পত্যজীবনের অন্তরঙ্গ দলিল, আর পত্রলেখকের পরিচয় রবীন্দ্রনাথ বলেই তা উত্তীর্ণ আশ্চর্য এক ইতিহাসেও। এ চিঠি বাঙালির পড়া, তবু দু’মলাটে বার বার ফিরে পড়ার বন্দোবস্ত করে দিল নতুন একটি বই, ভাই ছুটি: স্ত্রীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি (প্রকা: পূর্বা)। অমিত্রসূদন ভট্টাচার্যের সম্পাদনা, বই-শেষে যুক্ত হয়েছে প্রাসঙ্গিক তথ্য ও পর্যালোচনা-সমৃদ্ধ তাঁর তিনটি রচনাও। আনুষ্ঠানিক প্রকাশ হয়ে গেল গত ৮ নভেম্বর বিকেলে বইপাড়ায় এক সভাকক্ষে— বর্ষীয়ান সম্পাদকের বিরাশি বছরের জন্মদিনের উদ্‌যাপন অনুষ্ঠানও হল এই বইকে ঘিরেই। ছবিতে মৃণালিনী দেবী ও রবীন্দ্রনাথ।

    হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ বইটির জন্য আঞ্চলিক ইতিহাস-চর্চায় স্মরণীয় সুধীরকুমার মিত্র। এ বই লেখার সময়েই স্বাধীনতা আন্দোলনে জেলার বিপ্লবীদের ভূমিকা আলাদা করে লেখার কথা মনে হয় তাঁর। পরে কানাইলাল দত্তের আত্মবলিদান দিবসে এক সভায় এই বিপ্লবীর জীবনী লেখার প্রস্তাব আসে। লেখা হয় মৃত্যুঞ্জয়ী কানাই, প্রকাশিত ১৩৫৪ বঙ্গাব্দের পৌষে। একে একে লেখেন বাঘা যতীন, প্রফুল্ল চাকী, রাসবিহারী বসু ও নেতাজির জীবনী। এ বার একত্রে গ্রন্থিত পাঁচটি বই, পল্লব মিত্রের সম্পাদনায় বাংলার পাঁচ স্মরণীয় বিপ্লবী। আজ বিকেল সাড়ে ৪টায় আশুতোষ মেমোরিয়াল হল-এ, উদ্যোক্তা ক্যালকাটা কালচারাল সেন্টার। হবে প্রাসঙ্গিক আলোচনাও।

    সেতু হয়ে মুক্তমঞ্চে পৌঁছে যাবে স্থপতির সঙ্গীত, রবিবারের কলকাতায়। ফিল্ম, রেকর্ড, স্টুডিয়ো, মঞ্চ শাসন করা প্রাণহরা নামটির শিকড় প্রোথিত সবহারাদের মাঝে, সেখান থেকে উঠে আসা শ্রমসঙ্গীতই চেনায় সলিল চৌধুরীকে। গণনাট্য সঙ্ঘের মঞ্চে ছিল যাঁর অবাধ বিস্তার, সেই মানুষ ও শিল্পীকে ছোঁবে সলিল চৌধুরী জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপন কমিটি। আগামী কাল বিকেল ৪টেয় সুকান্ত সেতুর মোড় থেকে অনুরাগীদের পদযাত্রা, পৌঁছবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপেন এয়ার থিয়েটারে। অতঃপর ‘সোনালি স্বপন ভরা অন্তর’, ‘জাগো যারা জাগেনি’, ‘ও মশাই শুনছেন’, ‘আনন্দেরই গানে গানে সুরে’, ‘নবজীবনের রংমহল বানাই রে’... নানা অনুষ্ঠান। পরিচালনায় কল্যাণ সেন বরাট, রজত বন্দ্যোপাধ্যায়, বিজয়লক্ষ্মী বর্মণ।

    পঁচিশ বছর হল অশোকনগর নাট্যমুখ নাট্যগোষ্ঠীর। কলকাতা থেকে দূরে থাকার সঙ্গে যে ভাল থিয়েটার-চর্চার বিরোধ নেই, ওদের প্রযোজনাগুলিই প্রমাণ: এ বছরের গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণ ভেমুলার রামায়ণ, শেক্সপিয়ার মাস্ট ডাই এবং নবীনতমটি— আবার বাঞ্ছা। মনোজ মিত্র চলে গেলেন সম্প্রতি, ওঁর সাজানো বাগান-কেই বেছেছেন নির্দেশক অভি চক্রবর্তী, এরই মধ্যে নাটক ঘুরে এসেছে বাংলার নানা জায়গা। এ বার কলকাতা, এ শহরে প্রথম অভিনয় ২৯ নভেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়, অ্যাকাডেমি মঞ্চে। তৈরি হচ্ছে ছোটদের নাট্য নালক, রজতজয়ন্তী বর্ষ জুড়ে হবে আলোচনা, নাট্যগ্রন্থ প্রকাশ, দলের নাট্য-পরিসর ‘অমল আলো’ ঘিরে নাট্যোৎসব।

    “আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে,” রবীন্দ্রনাথের এই গান এ বার গীত ও পরিবেশিত হল নবতম এক রূপে, জার্মানির ডুসবার্গ শহরের অর্কেস্ট্রা-দল ‘ডুসবার্গার ফিলহারমনিকার’-এর উপস্থাপনায়। কলকাতার রবীন্দ্রসঙ্গীত-মহলে আদৃত মুখ কমলিনী মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠের সঙ্গে সঙ্গত করেছে পশ্চিমি অর্কেস্ট্রা-দলটির সদস্যাদের বাদন— স্যাক্সোফোন, নে, ভায়োলিন, ভিয়োলা, পার্কাশনের সুর-ছন্দ। অগস্টের কলকাতায় অভয়ার মৃত্যু প্রতিবাদে একত্র করেছে মানুষকে, শিল্পীরা কণ্ঠে তুলে নিয়েছেন স্লোগান-গান দুই-ই। এই প্রেক্ষিতেই কমলিনী ও তাঁর সঙ্গীদের এই নিবেদন, বহুশ্রুত রবীন্দ্রগানটি হয়ে উঠেছে একাধারে প্রতিবাদ ও প্রার্থনার আশ্রয়। গানটির মিউজ়িক ভিডিয়ো সংরক্ষিত অর্কেস্ট্রা-দলটির মিডিয়া লাইব্রেরিতে।

    দেশভাগ ও বাংলা ভাগ এমন এক বিপর্যয়, এত বছর পরেও যার ছাপ রয়ে গেছে বঙ্গজীবনে। প্রথম প্রজন্মের স্মৃতি কী ভাবে নিহিত উত্তরপ্রজন্মে, বোঝা যায় এ কালের জাতি রাষ্ট্র নাগরিকতা লিঙ্গবৈষম্যের তর্ক-বিতর্কে। বিশ শতক জুড়ে ভারত পাকিস্তান আফগানিস্তান শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশ মায়ানমারের মতো দেশগুলি নানা ওঠাপড়ার মধ্য দিয়ে গেছে; উত্তর-ঔপনিবেশিক কালপর্বেও এদের জনজীবনে পার্টিশনের যন্ত্রণা বহতা। এই প্রেক্ষিতে লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অ্যাডভান্সড রিসার্চ সেন্টার ও নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ল্যাঙ্গুয়েজ, ট্রান্সলেশন অ্যান্ড কালচারাল স্টাডিজ় একত্রে আয়োজন করছে আলোচনাচক্র, আগামী ২৬-২৮ নভেম্বর লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে। সূচনা-ভাষণ সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের, নানা অধিবেশনে বলবেন বিশিষ্ট লেখক গবেষক অধ্যাপকেরা। ২৭ তারিখে নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বেঙ্গল পার্টিশন রিপোজ়িটরি-র সমীক্ষকরা বলবেন তাঁদের প্রকল্প নিয়ে। ছবিতে উদ্বাস্তু মানুষের যাত্রা, প্রচারপত্র থেকে।

    ‘দ্য পরশমণি ইন মিউজ়িক’, এই নিয়ে এ বারের ‘চিদানন্দ দাশগুপ্ত স্মারক বক্তৃতা’ দেবেন টি এম কৃষ্ণ, কর্নাটকের বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী, লেখক ও সমাজকর্মী। সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের জীবনে শিল্পের প্রভাব নিয়ে বলবেন তিনি, শিল্পীর দৃষ্টিকোণ থেকে। আজ, ২৩ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় জি ডি বিড়লা সভাঘরে। চিদানন্দ দাশগুপ্ত (ছবি) চলচ্চিত্রের শিল্প-ইতিহাসের অন্যতম পুরোধা, লেখক, সমালোচক, চলচ্চিত্র পরিচালক এবং ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনের অগ্রদূত। জন্মশতবর্ষে তাঁর নামাঙ্কিত এই স্মারক বক্তৃতাটি শুরু হয়, আগের বছরগুলিতে বলেছেন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়, গোপালকৃষ্ণ গান্ধী ও শশী তারুর। এ বছর চতুর্থ বক্তৃতাটির আয়োজনে চিদানন্দ দাশগুপ্ত মেমোরিয়াল ট্রাস্টের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে সংস্কৃতি সাগর।

    “জন্মেছি শিল্পী বংশে, শিক্ষা পেয়েছি বিজ্ঞানের, কাজ করেছি মুচির আর ছুতোরের।” বলতেন রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মুচি আর ছুতোরের কাজ যে বৃহদর্থে কোন ‘মেরামতি’ আর নবনির্মাণের বিপুল দায়িত্বভার, তা জানে বিশ্বভারতী ও শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতনের ইতিহাস। একুশ শতকে নতুন করে মূল্যায়ন হচ্ছে সেই ইতিহাসের; ব্যক্তিগত জীবনেতিহাসের গণ্ডি ছাড়িয়ে লেখক, চিত্রশিল্পী, উদ্যান ও কৃষিবিশারদ, স্থপতি, পরিচালক-সংগঠক রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বহুমুখী প্রতিভার মূল্যায়ন হচ্ছে নতুন চর্চার আলোকে। তবু ক’জনই বা জানেন, এই মানুষটিই ‘রবীন্দ্রভারতী সোসাইটি’র রূপকার ও প্রতিষ্ঠাতা? রথীন্দ্রনাথের ১৩৭তম জন্মদিন আগামী ২৭ নভেম্বর, সে দিন সোসাইটির আয়োজনে রথীন্দ্র মঞ্চে অনুষ্ঠান বিকেল সাড়ে ৫টা থেকে, বিশিষ্টজনের উপস্থিতিতে। ‘রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্মারক বক্তৃতা’ দেবেন অধ্যাপিকা অপর্ণা ভট্টাচার্য।

  • Link to this news (আনন্দবাজার)