• জলা ভরাটে মরিয়া, ভেঙে পড়ছে খাদ্যশৃঙ্খল, পূর্ব কলকাতা জলাভূমি বুজিয়ে গড়ে উঠছে একের পর এক বেআইনি নির্মাণ
    এই সময় | ২৪ নভেম্বর ২০২৪
  • সায়েন্স সিটি ছাড়িয়ে ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাস থেকে কিছুটা এগিয়ে চোখে পড়বে বড় বড় জলাশয়। প্রায় ১২৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে অবস্থিত এই জলাভূমি আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃত। কলকাতা শহরের দূষিত নোংরা জল এখানে এসে জমা হয়। তারপর সেটা প্রাকৃতিক ভাবে শোধিত হয়। কিন্তু কোনও সময় যদি পুরো জলাভূমিটাই গায়েব হয়ে যায়, তখন কী হবে?

    পূর্ব কলকাতা জলাভূমিকে বাঁচিয়ে রাখতে দীর্ঘদিন ধরে লড়াই চালাচ্ছেন পরিবেশকর্মী বনানী কক্কর। জলাভূমি ভরাটের বিরুদ্ধে আদালতে বেশ কয়েকটি মামলাও করেছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘পূর্ব কলকাতা জলাভূমি বুজিয়ে যেভাবে একের পর এক বেআইনি নির্মাণ হচ্ছে তাতে ভবিষ্যতে এখানে আর জলের চিহ্নই খুঁজে পাওয়া যাবে না। এর ফল ভুগতে হবে কলকাতার মানুষকে।’

    গত বছরের ডিসেম্বর মাসে কলকাতা হাইকোর্টে রাজ্য সরকারের তরফ থেকে যে হলফনামা জমা পড়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, পূর্ব কলকাতা জলাভূমি এলাকায় এখনও পর্যন্ত ৫০০টি বেআইনি নির্মাণ চিহ্নিত করতে পেরেছে প্রশাসন। তার মধ্যে ৫২টি ভেঙে ফেলার আদেশ দিয়েছে আদালত। কিন্তু সেই নির্দেশ কার্যকর হয়নি।

    শুধু পূর্ব কলকাতার জলাভূমি নয়, গোটা শহর জুড়েই পুকুর ও জলাশয় ভরাট করে বাড়িঘর তৈরি হচ্ছে। পুরসভার হিসেব বলছে, গত তিন দশকে কলকাতা থেকে প্রায় পাঁচ হাজার পুকুর ও জলাশয় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। সবথেকে বেশি পুকুর ভরাট হয়েছে কলকাতা পুরসভার সংযোজিত এলাকায় (১০০–১৪৪ ওয়ার্ড)। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে গার্ডেনরিচ, যাদবপুর, বেহালা এবং টালিগঞ্জ। কলকাতা শহরে কতগুলো পুকুর ভরাট হয়েছে তার উপর একটি সমীক্ষা করেছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজ্য জলসম্পদ দপ্তর এবং তথ্য–প্রযুক্তি বিভাগ। সেই সমীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০০৪ সাল থেকে ২০২২–র মধ্যে শুধু গার্ডেনরিচ ও মেটিয়াবুরুজ এলাকার পাঁচটি ওয়ার্ডে মোট ২৭০টি পুকুর বোজানো হয়েছে।

    যাদবপুরের বিক্রমগড় ঝিলের একটা অংশ ভরাট করে সেখানে বাড়ি এবং গ্যারেজ বানানো হয়েছে। ইএম বাইপাসের পাশে আস্ত একটা পুকুর বুজিয়ে তৈরি হয়েছে হোটেল। রাজ্য জীববৈচিত্র্য পর্ষদের চেয়ারম্যান হিমাদ্রিশেখর দেবনাথ বলেন, ‘পুকুর বোজানোর ফলে কলকাতা শহরের ইকো সিস্টেম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পুকুরের জলে নানা ধরনের উদ্ভিদ ও পোকামাকড় থাকে। তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ায় খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে যাচ্ছে। এই ক্ষতি কোনও দিনই আর পূরণ হবে না।’

    কলকাতা পুরসভার টাউন প্ল্যানিং বিভাগের প্রাক্তন ডিজি দীপঙ্কর সিনহার ব্যাখ্যা, ‘বাস্তু জমির তুলনায় পুকুর অনেক কম পয়সায় কিনতে পাওয়া যায়। পুকুর ভরাট করে বাড়ি বানাতে পারলে প্রোমোটারদের লাভ বেশি হয়। সেই কারণেই এক শ্রেণীর অসাধু প্রোমোটার পুকুর ভরাট করতে পিছপা হয় না।’

    পুকুর ভরাট রুখতে পুরসভা কী করছে?

    গার্ডেনরিচে বাড়ি ভেঙে পড়ার ঘটনার পরে পুকুর ভরাট রুখতে হঠাৎ নড়চড়ে বসে কলকাতা পুরসভা। পুকুর ভরাট হচ্ছে কি না, তার উপর নজর রাখতে ১০ সদস্যের কমিটি তৈরি করা হয়। ঠিক হয়েছে, পুকুর ভরাট সংক্রান্ত যত অভিযোগ আসবে তা প্রতি মাসে পর্যালোচনা করব কমিটি। তার ভিত্তিতে পদক্ষেপ করবে পুরসভা।

    মেয়র ফিরহাদ হাকিমের দাবি, ‘পুকুর ভরাটের অভিযোগ পেলেই এখন সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পুকুর ভরাট হয়ে গেলে সেটাকে আবার নতুন করে খনন করা হয়। এরকম অনেকগুলো পুকুরকে পুনরুদ্ধার করা হয়েছে।’ তাঁর অভিযোগ, ‘পুকুর ভরাটের অভিযোগ এলে পুরসভা যখনই ব্যবস্থা নিতে যায়, অভিযুক্তরা আদালতে চলে যায়। বছরের পর বছর ধরে মামলা চলতে থাকে। ফলে বিষয়টা ধামাচাপা পড়ে যায়।’
  • Link to this news (এই সময়)