আরজি করে সক্রিয়, অঙ্ক কষে জোট, তবু বিধি বামই, রাজ্যের ছ’টি কেন্দ্রের উপনির্বাচনের ফলে দেখা গেল, বামেরা তলিয়ে গেল আরও গভীর তিমিরে
এই সময় | ২৪ নভেম্বর ২০২৪
এই সময়: আরজি কর আন্দোলনে প্রতিবাদ মিছিল ও জমায়েতে সামনের সারিতে ছিল বামেরা। এই ধারণা কিছুটা হলেও ছড়িয়ে যায় যে, রাজ্য রাজনীতিতে বামেদের অন্তত দ্বিতীয় শক্তি হিসেব উঠে আসার লঞ্চিং প্যাড আরজি কর আন্দোলন জুগিয়ে দিয়েছে। আবার উপনির্বাচনে ছুঁতবার্গ বর্জন করে নকশালপন্থী দল সিপিআই-এমএলের (লিবারেশন) সঙ্গে নৈহাটি বিধানসভা কেন্দ্রে সিপিএম ‘ঐতিহাসিক’ জোট করেছিল।
হাড়োয়া বিধানসভা ভোটে বামেরা জোট করে সেই আইএসএফের সঙ্গে, যাদের সঙ্গে তিক্ততার কারণে সাত-আট মাস আগেও লোকসভা ভোটে জোট ভেস্তে গিয়েছিল। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না। শনিবার রাজ্যের ছ’টি কেন্দ্রের উপনির্বাচনের ফল বেরোতে দেখা গেল, বামেরা যে তিমিরে ছিল, তলিয়ে গেল তার চেয়ে আরও গভীর তিমিরে। প্রতিটি আসনেই বামেরা এবং বামেদের জোটসঙ্গীরা জামানত খুইয়েছে।
সিপিএমের প্রবীণ নেতা সুজন চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘আরজি কর ইস্যু তো নির্বাচনী ইস্যু নয়। নির্বাচনের জন্য আমরা আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদে সামিল হয়েছিলাম, এমন ভাবনা ভুল।’ সিপিএমের আর এক প্রবীণ নেতা রবীন দেব বলছেন, ‘আমাদের কিছু দুর্বলতা রয়েছে। সব জায়গায় লড়াই করতে পারিনি।’ তবে সুজন ও রবীন দু’জনই নির্বাচনে কারচুপির দিকে ইঙ্গিত করেছেন। তৃণমূল অবশ্য ওই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে।
এ বারের উপনির্বাচনে বামেদের দুরবস্থার সব চেয়ে বড় দৃষ্টান্ত সম্ভবত নৈহাটি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের অভিমত ছিল, দ্রোহের মিছিল ও জমায়েত সাড়া ফেলেছে শহর ও শহরাঞ্চলে। তাই, শহরাঞ্চলে আরজি করের ঘটনা ও আন্দোলনের প্রভাব পড়বেই। ছ’টি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে একমাত্র নৈহাটি পুরোপুরি শহরাঞ্চল। আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদে নৈহাটিতে গত ৮ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন স্কুলের প্রাক্তনীদের প্রতিবাদ মিছিলে হামলা চলেছিল এই নৈহাটিতেই এবং অভিযোগের নিশানায় ছিল তৃণমূল। উপনির্বাচনের প্রচারে বিরোধীরা ওই ঘটনাকে বার বার তুলে ধরেছিল। সিপিএম এই আসন ছেড়েছিল তাদের নতুন জোটসঙ্গী সিপিআই-এমএলকে (লিবারেশন)।
সেই লিবারেশনের প্রার্থী দেবজ্যোতি মজুমদার বলেন, ‘দ্রোহকালে মানুষ যে ভাবে সরকারের চোখে চোখ রেখে নৈহাটিতে প্রতিবাদে সরব হয়েছিলেন, তার প্রভাব ভোটবাক্সে পড়বে।’ কিন্তু কোথায় কী? দেবজ্যোতি পেয়েছেন ৬.০৭ শতাংশ ভোট। এ বছর লোকসভা ভোটে নৈহাটি বিধানসভা কেন্দ্রে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে লড়া বামদের ভোটের হার ছিল ৯.৫৫ শতাংশ। অর্থাৎ, উপনির্বাচনের নতুন বাম জোট লোকসভা ভোটের বাম জোটের তুলনায় খারাপ ফল করেছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের প্রশ্ন, লিবারেশনকে আসন ছেড়ে দেওয়ার কারণেই কি বামেরা নিজেদের ঘরের ভোটও হারাল?
ব্যারাকপুরের সাংসদ, তৃণমূলের পার্থ ভৌমিক বলছেন, ‘বামেদের একটা অংশ এ বার তৃণমূলকে ভোট দিয়েছেন। তাঁদের সাধুবাদ জানাই।’ লিবারেশন প্রার্থী দেবদ্যোতি মজুমদার বলছেন, ‘হয়তো নিচু তলা পর্যন্ত জোটের বাস্তবতা বোঝানো যায়নি।’ সিপিএমের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক মৃণাল চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘দীর্ঘদিন বাদে হওয়া বৃহত্তর বাম ঐক্য নিচু তলা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া এবং মানুষকে বোঝানোর সময় অনেকটা কম পাওয়া গিয়েছে।’ সিপিএমের জেলা সম্পাদকের কথায়, ‘আরজি কর নিয়ে যাঁরা নৈহাটিতে রাস্তায় নেমেছিলেন, তাঁরা আদৌ ভোট দিলেন কি না, দিলে কোথায় দিয়েছেন, নাকি উপনির্বাচন বলে অনেকে ভোট দিতে যাননি, সে সব প্রশ্নের উত্তর আমাদের খুঁজতে হবে।’
এ দফায় উপনির্বাচন হওয়া মেদিনীপুর বিধাসভা কেন্দ্রও আংশিক শহরাঞ্চল। এখানে সিপিআই প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের হার লোকসভা ভোটের ফলের নিরিখে ০.৮ শতাংশ বেড়েছে।
এমন সান্ত্বনা পুরস্কার হয়তো হাড়োয়া বিধানসভা কেন্দ্রেও। যেহেতু বামেদের জোটসঙ্গী আইএসএফ সেখানে বিজেপিকে টপকে দ্বিতীয়। যেখানে বাম ও জোটসঙ্গীরা তৃতীয় স্থানে বাকি পাঁচটি কেন্দ্রে। হাড়োয়ায় ৭০ শতাংশের বেশি সংখ্যালঘু ভোটার। সে কথা মাথায় রেখে আইএসএফের সঙ্গে ফের জোট করে আসনটা তাদের ছেড়ে দিয়েছিল বামেরা। কিন্তু এ বছর লোকসভা ভোটে একা লড়ে আইএসএফ যেখানে প্রায় ১৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিল, সেখানে উপনির্বাচনে বাম-আইএসএফ জোট পেয়েছে সাড়ে ১২ শতাংশের সামান্য বেশি ভোট। সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলী সদস্য আলি আহমেদ খান বলেন, ‘বামেদের ভোট জোটসঙ্গী ছাড়া অন্য কোথাও পড়েছে কি না, সেটা দেখা হবে।’
সিপিএমের যুব সংগঠন, ডিওয়াইএফআইয়ের রাজ্য সম্পাদক মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়ের অবশ্য বক্তব্য, ‘আজ হয়নি বলে কাল হবে না তা নয়।’
কিন্তু সিপিএমের অন্দরেই প্রশ্ন, সেই ‘কাল’-টা কবে আসবে?