• প্রয়াত ৭৫–এর সর্পবন্ধুর জন্য মনখারাপ ৭৭–এর শিবেন্দ্রর
    এই সময় | ২৫ নভেম্বর ২০২৪
  • বয়স ৭৭। চোখে হাই পাওয়ারের চশমা। জীবনে চলার গতি ক্রমশ শ্লথ হয়েছে। তবু যখনই কোনও বিষধর সাপের মুখোমুখি হন, চনমনে করে ওঠে তাঁর মন। টান টান হয় স্নায়ু, ক্ষিপ্রতা যেন ভর করে শরীরে। পলক পড়ার আগেই কব্জা করে ফেলেন ফনা তোলা কেউটে, গোখরোকে। তবুও কালনার সেই ‘তরুণ’ শিবেন্দ্রনারায়ণ সরকারের এখন মন বিষণ্ণ।

    সদ্য বিষধর সাপের ছোবলে প্রয়াত হয়েছেন সর্পবন্ধু দীপক সর্দার। শিবেন্দ্র আর দীপক ছিলেন পিঠোপিঠি। গত মঙ্গলবার সাপকে খাওয়াতে গিয়ে মেদিনীপুরের ডেবরার বালিচকের বাসিন্দা ৭৫–এর দীপক সর্দার নিজেকে সামলাতে পারেননি। মুহূর্তের অসতর্কতায় বিষধর কেউটে তাঁকে ছোবল মারে। ডেবরা সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে আনা হলেও বাঁচানো যায়নি তাঁকে। দীপকের প্রয়াণের খবর পেয়েছেন শিবেন্দ্র। তার পর থেকেই মনখারাপ।

    তবে প্রায় সমবয়সি সর্পবন্ধুর মৃত্যুর খবরে শরীরে বিষাদ ছায়া ফেললেও ভয় পাওয়ার মানুষ নন শিবেন্দ্র। জানিয়েছেন, যতদিন বাঁচবেন, সাপ ধরবেন। গত শনিবারও দুটো কেউটে ধরেছেন তিনি। কালনা শহর বা আশপাশে বিষধর সাপ নজরে এলেই ডাক পড়ে ১১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা স্বাস্থ্য দপ্তরের অবসরপ্রাপ্ত কর্মী শিবেন্দ্রর।

    এ পর্যন্ত ১৩ হাজারের মতো সাপ ধরেছেন তিনি। নির্বিষ সাপ উদ্ধার করে ছেড়ে দেন কাছাকাছি কোনও খোলা জায়গায়। আর সাপ বিষধর হলে তুলে দেন বন দপ্তরের হাতে। এই বয়সে বিষধর সাপ ধরতে ভয় পান না? প্রশ্ন শুনে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে শিবেন্দ্র জবাব দেন, ‘না না একদম ভয় পাই না। সাপ ধরতে গিয়ে একটা কথাই মাথায় থাকে, হয় সাপ জিতবে না হলে আমি জিতব। মানে হয় আমি সাপকে ধরব না হলে ছোবল খাব। খুব সতর্ক থাকতে হয়।’

    দীপক সর্দারের প্রসঙ্গে বলেন, ‘শুনেছি উনি তখন সাপকে খাওয়াতে গিয়েছিলেন। ওখানেই কোথাও ভুল হয়ে গিয়েছে।’ সাপের মতো বন্যপ্রাণীকে তিনি খাওয়ানোর পক্ষপাতী নন জানিয়ে শিবেন্দ্র বলেন, ‘আমি কখনও সাপকে খাওয়াই না। সাপ এমনিতেই না খেয়ে এক বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।’ যোগ করেন, ‘তবে বন দপ্তর নিয়ে যেতে দেরি করলে জার থেকে সাপ বার করে কলের নীচে রেখে স্নান করিয়ে দিই।’

    জানাচ্ছেন, সতর্কতায় এতটুকু খামতি রাখেন না। স্নেক ক্যাচার ছাড়া সাপ ধরেন না। পায়ে বুট পরেন। খাঁচার মধ্যে আটকে পড়া সাপ উদ্ধারের সময়ে হাতে বিশেষ গ্লাভস ব্যবহার করেন। বলেন, ‘সবচেয়ে সতর্কতা প্রয়োজন সাপকে জারবন্দি করার সময়ে। বিশেষ করে জারের ঢাকনা লাগানোর সময়ে এতটুকু অন্যমনস্ক হলে চলবে না।’

    কালনা মহকুমায় সর্প বিশেষজ্ঞ হিসেবে এখন তাঁর পরিচিতি বেড়েছে। বিভিন্ন এলাকা থেকে নিয়মিত ডাক আসে। বাড়ি, হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে ধরে আনা সাপ নিয়ে অবশ্য সমস্যায় রয়েছেন তিনি। বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমার কাছে ১৭টি সাপ রয়েছে। বন দপ্তর নিয়মিত সাপ নিতে আসে না। জার, টর্চ, স্নেক ক্যাচারের মতো উপকরণ সবই নিজের পেনশনের টাকায় কিনি। সাপ রাখার জন্য জায়গার আবেদন করেছিলাম কিন্তু, তা পাইনি।’

    সাপ ধরার বিদ্যা শিবেন্দ্র শিখিয়েছেন এলাকারই বাসিন্দা দুর্গা বারিককে। প্রতিটি অভিযানে তিনি এখন সঙ্গী শিবেন্দ্রর। দুর্গা বলেন, ‘গত বছরের মে মাসে সাপ ধরতে গিয়ে বড় বিপদের হাত থেকে জেঠুই বাঁচিয়েছেন। ৫ ফুট দীর্ঘ গোখরোর মাথার হাত দেড়েক নীচে ধরে ফেলেছিলাম। মুহূর্তে জেঠু বুঝে যান, সাপ গলা বেঁকিয়ে আমাকে ছোবল মেরে দেবে। সঙ্গে সঙ্গে অত্যন্ত ক্ষিপ্রতায় ক্যাচার দিয়ে সাপের মাথা আটকে দেন উনি।’ দুর্গা বলছেন, ‘জেঠু থাকলে হয়তো দীপক সর্দারের ওই পরিণতি হতো না। উনি সতর্ক করে দিতেন।’
  • Link to this news (এই সময়)