দু’দশক ধরে বিনা বেতনে ব্ল্যাকবোর্ড আর চক-ডাস্টারই সঙ্গী মিলন মাস্টারের
এই সময় | ২৭ নভেম্বর ২০২৪
এই সময়, তুফানগঞ্জ: ছাত্র পড়ানোই তাঁর নেশা। সেই নেশার টানে বিনা বেতনে শিক্ষকতা করে চলেছেন তিনি। তাও এক–দু’ বছর নয়, দীর্ঘ ২২ বছর থেকে। ব্ল্যাকবোর্ড আর চক–ডাস্টারকে সঙ্গী করে কখন যে পোষাকি নাম মৃত্যুঞ্জয় লাহিড়ি হারিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন গ্রামের মিলন মাস্টার, তা নিজেই জানেন না। তুফানগঞ্জের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম মহিষকুচি নিম্ন বুনিয়াদি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
এই স্কুলে পড়ুয়া থেকে অভিভাবকদের একমাত্র ভরসা ৬৭ বছরের মিলন মাস্টারই। না আছে বেতন, না আছে প্রমোশন, স্বেচ্ছায় শিক্ষকতা করে চলেছেন তিনি। বিয়ে করেননি, স্কুলের চার দেওয়ালের মধ্যে খুদে পড়ুয়াদের নিয়েই জীবন কাটছে তাঁর। মিলন মাস্টার বলেন, ‘স্কুলের পড়ুয়ারা আমার কাছে সন্তানের মতো। বেতন না পাই তাতে বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই। যতদিন বেঁচে আছি শিক্ষাদান করে যাচ্ছি ও যাব।’
ঠিক ৯টা বাজলেই স্নান সেরে তৈরি হয়ে স্কুলে যান মৃত্যুঞ্জয় ওরফে মিলন। স্কুলের গেটে পা রাখলেই দূর থেকে শোনা যায় গড় গড় করে পড়িয়ে চলেছেন তিনি। বর্তমানে ওই স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা ১৫০ জন হলেও, শিক্ষক রয়েছেন পাঁচ জন। বক্সিরহাটের গৃহশিক্ষক শালডাঙ্গার বাসিন্দা মৃত্যুঞ্জয় থেকে মিলন ওঠার গল্পটা বেশ চমকপ্রদ। মহিষকুচি নিম্ন বুনিয়াদী বিদ্যালয়ে ভাইপোকে ভর্তি করাতে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তখন তিনি চুটিয়ে গৃহশিক্ষকতা করেন।
স্কুলে গিয়ে দেখেন, পড়ুয়ার সংখ্যা প্রায় সাড়ে পাঁচশো, কিন্তু শিক্ষকের সংখ্যা চার এবং ক্লাসঘরের সংখ্যা পাঁচ। খুব স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষকদের উপর চাপ বড্ড বেশি। তখনই আলাপ হয় প্রধান শিক্ষক তারাপ্রসাদ ভট্টাচার্যের সঙ্গে। তিনি যে গৃহশিক্ষকতা করেন, প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে প্রথম আলাপে তা জানিয়ে দেন মৃত্যুঞ্জয়।
তারাপ্রসাদ তাঁকে স্কুলের হাল জানিয়ে সময় পেলে বিনা পয়সায় স্কুলে এসে ছাত্র পড়ানোর কথা বলেন। প্রধান শিক্ষকের ডাকে সাড়া দিতে এতটুকু সময় নেননি তিনি। সেই ২০০২ সাল থেকে মিলন মাস্টারের শিক্ষকতার যাত্রা শুরু। এখনও শিক্ষকতা করে চলছেন ওই স্কুলেই। প্রতিদিন সবার আগে স্কুলে গিয়ে ক্লাসঘরের তালা খোলেন। নিয়মিত অঙ্ক, ইংরেজি ও বাংলার ক্লাস নেন।
স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র রাজু সরকার বলেন, ‘আমি নিজে ছোটবেলায় মিলন মাস্টারের কাছে পড়েছি। আমার ছেলেরাও এই স্কুলে মিলন মাস্টারের কাছে পড়ে। উনি যেভাবে বিনা বেতনে মানুষ গড়ে চলেছেন, তা সত্যিই দৃষ্টান্তমূলক। মহিষকুচি নিম্ন বুনিয়াদি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বর্তমান প্রধান শিক্ষক সুব্রত সাহা বলেন, ‘মিলন মাস্টারের আর্থিক পরিস্থিতি ভালো নয়। স্কুলের শিক্ষকরা তাঁকে সাহায্য করতে চাইলেও তা নিতে রাজি নন তিনি। তাঁর নেশা কেবল শিক্ষকতা। সেই নেশার টানেই আজও ছাত্রদের পড়িয়ে চলেছেন তিনি। ওঁর অভিধানে কোনও অবসর নেই।’