ছ’বছর আগে হিমোফিলিয়া রোগীদের চিকিৎসায় রক্তের প্লাজ়মা থেকে তৈরি ‘ফ্যাক্টর-৮’ রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরে সরবরাহ শুরু করেছিল অম্বানীদের রিলায়্যান্স গোষ্ঠী। সেই সময়ে এ নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন রক্তের বিশেষজ্ঞ ও হিমোফিলিয়া রোগীদের বড় অংশ। তাঁদের অভিযোগ ছিল, ওই ধরনের ফ্যাক্টর থেকে গ্রহীতার দেহে সংক্রমণ হওয়ার প্রবল আশঙ্কা থাকে। তাঁরা আস্থা দেখিয়েছিলেন বহুজাতিক ওষুধ সংস্থার তৈরি ‘রিকম্বিন্যান্ট ফ্যাক্টর’-এ (যে ফ্যাক্টর রক্ত থেকে তৈরি নয়)। মূলত এই প্রতিবাদের জেরে রাজ্যের স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে থেকে সেই সময়ে ব্যবসা গোটাতে হয় রিলায়্যান্সকে।
তার পর থেকে হিমোফিলিয়া রোগীদের জন্য প্রধানত তিনটি বহুজাতিক ওষুধ সংস্থা রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরে ফ্যাক্টর-৮ সরবরাহ করেছে। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে অত্যন্ত অনিয়মিত ছিল তার জোগান। রাজ্যের কোনও সরকারি হাসপাতালে মিলছিল না। দিশাহারা অবস্থা হয়েছিল রোগীদের। সরবরাহ কমানোর পাশাপাশি মার্চ মাসে স্বাস্থ্য দফতরের ডাকা নতুন দরপত্রে কোনও বহুজাতিক সংস্থা অংশ নেয়নি। ঠিক তখনই আসরে ফের নামে রিলায়্যান্স। ছ’বছর পরে তারা আবার ফ্যাক্টর-৮ সরবরাহের জন্য দরপত্রের মাধ্যমে স্বাস্থ্য দফতরের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় সেপ্টেম্বরে।
এর প্রায় দু’মাস পরে মঙ্গলবার থেকে রাজ্যের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে প্লাজ়মা থেকে তৈরি ফ্যাক্টর-৮ দেওয়া শুরু করেছে অম্বানী গোষ্ঠী। এ বারেও প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল, কিন্তু তা ধোপে টেকেনি। প্রথম দফায় ৪২৫০ বোতলে প্রায় ১০ লক্ষ ইউনিট ফ্যাক্টর-৮ মঙ্গলবার বর্ধমান, আসানসোল, পুরুলিয়া, দুই ২৪ পরগনা, বাঁকুড়া, হুগলির মতো একাধিক জেলায় সরবরাহ শুরু হয়েছে। ছ’বছর পরে আন্তর্জাতিক সংস্থার বদলে ফের রিলায়্যান্সেই আস্থা রেখেছে স্বাস্থ্য দফতর।
হিমোফিলিয়া রোগীদের অন্যতম সংগঠন ‘হিমোফিলিয়া সোসাইটি অব কলকাতা’-র সহ-সচিব টোটোন বিশ্বাস অবশ্য দাবি করেন, ‘‘রিলায়্যান্সের প্লাজ়মা থেকে তৈরি ফ্যাক্টর-৮ নিয়ে প্রথম থেকেই আমাদের আপত্তি ছিল। কারণ, এটা অত্যন্ত পুরনো প্রযুক্তিতে তৈরি এবং এর থেকে রোগীর দেহে সংক্রমণের আশঙ্কা খুবই বেশি। ২০১১ সালে বিহার ও উত্তরপ্রদেশে রিলায়্যান্সের ফ্যাক্টর নিয়ে এই রকম সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছিল।’’
তাঁদের আরও অভিযোগ, স্বাস্থ্য দফতর সংক্রমণের ঝুঁকিহীন ‘রিকম্বিন্যান্ট ফ্যাক্টর’ কেনার জন্য টাকা বাড়াতে নারাজ হওয়ায় গত মার্চ থেকে সরকারি দরপত্রে কোনও আন্তর্জাতিক সংস্থা অংশ নেয়নি। হিমোফিলিয়া রোগীদের কথায়, ফ্যাক্টর-৮ এর আকাল নিয়ে গত এপ্রিলে স্বাস্থ্যকর্তাদের একটি বৈঠক হয়। তাতে ঠিক হয়, ফ্যাক্টর-৮ এর বিকল্প হিসাবে বিশেষ একটি থেরাপি চালু করতে স্বাস্থ্য দফতর একটি ইনজেকশন কিনবে। এতে বছরে স্বাস্থ্য দফতরের ৬২ কোটির মতো খরচ পড়বে। কিন্তু তার পর হঠাৎই স্বাস্থ্য দফতর সেই সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসে এবং দরপত্রের মাধ্যমে রিলায়্যান্সের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়।
স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, ‘‘দেশের প্রায় ২০টি রাজ্যের সরকারি স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে রিলায়্যান্সের ওই প্লাজ়মা থেকে তৈরি ফ্যাক্টর-৮ ব্যবহার হয়। কোথাও কোনও সমস্যা হচ্ছে না। বহুজাতিক সংস্থাগুলি যে দাম চাইছে, সেটা অনেক বেশি। যে ইনজেকশনের কথা হয়েছিল, সেটাও অত্যন্ত দামি। সরকারি জায়গায় বিপুল রোগীকে তা দেওয়া সম্ভব নয়।’’
রিলায়্যান্সের তরফে অতনু চক্রবর্তী বলেন, ‘‘দেশীয় জিনিসের কদর করতে এখনও অনেকে দ্বিধা করেন, এটা দুর্ভাগ্যজনক। অ্যালবুমিন, ইমিউনোগ্লোবিউলিনের মতো অসংখ্য ওষুধ প্লাজ়মা থেকে তৈরি হচ্ছে। অথচ ‘প্লাজ়মা ডেরাইভড ফ্যাক্টর-৮’-এর ক্ষেত্রে অযথা সংক্রমণের ভয় তৈরি করা হচ্ছে। এক শ্রেণির আন্তর্জাতিক ওষুধ সংস্থা নিজেদের স্বার্থে কিছু চিকিৎসক ও রোগী-সংগঠনকে দলে টেনে এটা করছে। এর জন্যই ২০১৮ সালে আমাদের পশ্চিমবঙ্গ থেকে চলে যেতে হয়েছিল।’’
অতনু আরও বলেন, ‘‘যখনই স্বাস্থ্য দফতর টাকা বাড়াতে রাজি হল না, তখনই বহুজাতিক সংস্থাগুলির স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হল। তারা তখন রোগীদের অসুবিধার কথা না ভেবে চম্পট দিল। প্রয়োজনের সময়ে কিন্তু দেশীয় সংস্থা রিলায়্যান্সই রোগীদের পাশে দাঁড়িয়েছে।’’