নাবালিকা প্রসূতির ক্ষেত্রে লাল তালিকায় আটটি ব্লক, জেলায় স্কুলে স্কুলে সচেতনতার উদ্যোগ
বর্তমান | ২৮ নভেম্বর ২০২৪
অগ্নিভ ভৌমিক, কৃষ্ণনগর : চাপড়ার রাজমিস্ত্রির মেয়ে সোনিয়া খাতুন (নাম পরিবর্তিত)। আর্থিক অনটনের কারণে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার আগেই কৈশোর জীবন বদলে যায় সংসার জীবনে। স্কুলছুটের তালিকায় নাম ওঠে তার। কিছুদিনের মধ্যেই খবর আসে, খুদে বয়সেই সে গর্ভবতী। স্বাভাবিকভাবেই শারীরিক দুর্বলতা তৈরি হয়।
সোনিয়া একটি উদাহরণ মাত্রা। নদীয়া জেলায় এভাবে বহু নাবালিকার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে সন্দর্পণে। মাও হচ্ছে তারা। সঙ্গতকারণেই বাল্য বিবাহ রোধে সরকারের সচেতনতামূলক প্রচার প্রশ্নের মুখে। চলতি বছরে জেলার গ্রামীণ ও শহর এলাকায় ৬ হাজার ৩৭২ জন নাবালিকা প্রসূতি রয়েছেন। সমগ্র নদীয়া জেলায় সংখ্যাটা ৩২ হাজার ১৯৭। অর্থাৎ, নদীয়া জেলায় অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার মায়েদের মধ্যে পাঁচ ভাগের মধ্যে এক ভাগ মায়ের বয়স আঠারো বছরের নীচে। তাদের মধ্যে সিংহভাগই গ্রামীণ এলাকায়। এমনটাই স্বাস্থ্য দপ্তর সূত্রে খবর।
দেখা যাচ্ছে, স্কুলছুট প্রবণতা বেশি থাকা ব্লকগুলিতেই নাবালিকা প্রসূতির সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার ভিত্তিতে চাপড়া, কালীগঞ্জ, করিমপুর-১, করিমপুর-২, কৃষ্ণনগর-২, নবদ্বীপ, নাকাশিপাড়া, তেহট্ট-২—এই আটটি ব্লককে লাল তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তবে, কালীগঞ্জ ব্লক ও করিমপুর-২ ব্লকে নাবালিকা প্রসূতির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। উভয় ব্লকে চলতি বছরে মোট প্রসূতির ২৭ শতাংশই নাবালিকা। জেলাশাসক অরুণপ্রসাদ বলেন, ‘এই ধরণের সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য রাজ্য সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প রয়েছে। সেই প্রকল্পের সুবিধা যাতে সকলে পায়, তার দিকে আমরা বিশেষভাবে নজর দিচ্ছি। পাশাপাশি সচেতনতামূলক কাজ চলছে জেলাজুড়ে।’
২০২৩-২৪ অর্থ বছরে নদীয়া জেলায় প্রায় দু’হাজার ছাত্রী স্কুলছুট হয়েছে। শুধু চাপড়া ব্লক স্কুলছুট ছাত্রীর সংখ্যা ৪৮২ জন। এছাড়াও কালীগঞ্জ ব্লকে ২০৬ জন, নাকাশিপাড়া ব্লকে ২৭২ জন। এবার সেই সমস্ত ব্লকেই চলতি বছরে নাবালিকা প্রসূতির গ্রাফ উর্ধ্বমুখী। চাপড়া ব্লকে ২ হাজার ৩৯৫ জন প্রসূতির মধ্যে ৫৬৪ জন প্রসূতির বয়স আঠারোর নীচে। শতাংশের নিরিখে যা ২৪ শতাংশ। কালীগঞ্জ ব্লকে ৩ হাজার ৩৩৭ জন প্রসূতির মধ্যে ৮৯৫ জন এবং করিমপুর-২ ব্লকে ১ হাজার ৭৬০ জনের মধ্যে ৪৭৩ জন নাবালিকা। নাকাশিপাড়া ব্লকে ৩ হাজার ১৯৯ জন প্রসূতির মধ্যে ৮২০ জন, করিমপুর-১ ব্লকে ১ হাজার ২৫৩ জনের প্রসূতির মধ্যে ৩১৩ জনের বয়স আঠারো বছরের নীচে। এছাড়াও নবদ্বীপ ও তেহট্ট-২ ব্লকে ২২ শতাংশ এবং কৃষ্ণনগর-২ ব্লকে ২১ শতাংশ প্রসূতিই নাবালিকা।
কৃষ্ণনগর সদরের মহকুমা শাসক শারদ্বতী চৌধুরী বলেন, ‘বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। কালীগঞ্জ, নাকাশিপাড়া, চাপড়ার মতো প্রত্যন্ত ব্লকগুলির স্কুলে বাল্যবিবাহ ও স্কুলছুটের মতো বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে নিয়মিত।’
স্কুলছুট, বাল্যবিবাহ ও নাবালিকা প্রসূতি—এই তিন সামাজিক সমস্যাই একই সুতোয় বাঁধা। গ্রামীণ এলাকার মানুষদের আর্থসামাজিক সংকট এর অন্যতম কারণ বলে সমাজবিজ্ঞানীদের মত। যদিও রাজ্য সরকারের তরফে রূপশ্রী, কন্যাশ্রী, তরুণের স্বপ্ন-এর মতো একাধিক প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য হল স্কুলছুট, বাল্যবিবাহ ও নাবালিকা প্রসূতির মতো সমস্যাগুলোর সমাধান করা। কিন্তু, তাতেও রোধ করা যাচ্ছে না বাল্য বিবাহের মতো গুরুতর সমস্যা। স্বভাবতই গ্রাউন্ডস্তরে প্রকল্পের সুফল কতটা মিলছে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
সম্প্রতি নিজের বিয়ে আটকে রাজ্যের তরফে ‘বীরঙ্গনা’র সম্মান পেয়েছে কৃষ্ণনগরের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী মারিয়াম খাতুন। অন্যদিকে, বিয়েতে মত না থাকায় প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে আসতে গিয়ে খুন হতে হয়েছে ভীমপুরের নবম শ্রেণিরএক নাবালিকা ছাত্রীকে। দু’টো ঘটনাকে সামনে রেখে সচেতনার উপর জোর দেওয়ার পক্ষে সমাজবিজ্ঞানীরা।