কেন এমন সিদ্ধান্ত? পোশাকি কারণ, খুব জাঁকজমক না করে ‘ছোট’ করে অনুষ্ঠান করা। কিন্তু শাসক শিবির এবং প্রশাসনিক মহল জানে, কারণ আরজি কর আন্দোলন। তৃণমূলের এক ‘প্রভাবশালী’ এবং মুখ্যমন্ত্রীর ‘আস্থাভাজন’ নেতার কটাক্ষ, ‘‘আরও কালো পোশাক পরে রাস্তায় নামো!’’
কটাক্ষের লক্ষ্য খুব স্পষ্ট। আরজি কর-কাণ্ডের পরে ‘নাগরিক আন্দোলনে’ শামিল হয়েছিলেন টলিউডের অনেকে। কেউ কেউ সরাসরি নাগরিক মিছিলে না হেঁটে পৃথক ভাবেও মিছিল করেছিলেন। ‘বিচার’ চেয়ে স্লোগান দিয়েছিলেন। এমনকি, শাসকদল তথা সরকার এবং কলকাতা পুলিশের ভূমিকার কড়া সমালোচনাও করতে পিছপা হননি। তারকাদের অনেকে টালিগঞ্জের স্টুডিয়োর সামনে জমায়েত হয়ে আরজি কর হাসপাতালের সামনে যাওয়ার কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছিলেন। ঘটনাচক্রে, তখন শ্যামবাজার থেকে আরজি কর পর্যন্ত জমায়েত বা মিছিল ‘নিষিদ্ধ’ ছিল। তাতে দমেননি টালিগঞ্জের ওই ‘ক্ষুব্ধ’ তারকারা। বাস ভাড়া করে ‘খন্না সিনেমা’ পর্যন্ত গিয়ে সেখান থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত মিছিল করেছিলেন তাঁরা। সেই মিছিলে যেমন ছিলেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায়, অঙ্কুশ হাজরা, আবির চট্টোপাধ্যায়, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়েরা, তেমনই ছিলেন তৃণমূল বিধায়ক তথা পরিচালক রাজ চক্রবর্তী (তবে রাজকে তার পর থেকে আর মিছিলে দেখা যায়নি)। ছিলেন রাজের স্ত্রী অভিনেত্রী শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়ও। প্রতিবাদ প্রদর্শনে অধিকাংশেরই পরনে ছিল কালো পোশাক।
আবার স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়, দেবলীনা দত্ত, সোহিনী সরকার, সুদীপ্তা চক্রবর্তী, বিদীপ্তা চক্রবর্তীদের মতো অভিনেত্রীরা নাগরিক মিছিলে পা মেলানোর পাশাপাশি ধর্মতলায় রাতভর অবস্থান করেছিলেন। অনেকে রাস্তায় না নামলেও সমাজমাধ্যমে সরব হয়েছিলেন। যেখানে সরকারের কঠোর সমালোচনা ধ্বনিত হয়েছিল। যেমন সেন্ট জেভিয়ার্সের প্রাক্তনীদের ডাকা মিছিলে দক্ষিণ কলকাতায় পা মিলিয়েছিলেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, পাওলি দাম, অরিন্দম শীল, টোটা রায়চৌধুরীরা।
সেই ‘বিচার’ চাওয়ার আবহেই টালিগঞ্জের সিনেমাপাড়ায় মন্ত্রী (তথা টালিগঞ্জের বিধায়ক) অরূপ বিশ্বাসের ভাই স্বরূপ বিশ্বাসকে এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন চলচ্চিত্র ফেডারেশনকে নিয়ে ‘সরব’ হয়েছিলেন এই ‘বিক্ষুব্ধ’ পরিচালকেরা। যাঁরা একই সঙ্গে অভিনেতাও বটে। দু’পক্ষে টানাপড়েন কম হয়নি। যার শুরু হয়েছিল আরজি কর-কাণ্ডের আগে এক পরিচালককে নিয়ে। কিন্তু আরজি করের ঘটনার পরে সেই বিষয়ের সঙ্গে সামগ্রিক ভাবে স্বরূপ তথা ফেডারেশনের ‘দাদাগিরি’র বিষয়টি নিয়ে সরব হতে থাকেন অনেকে। তখনই অনেকে বলেছিলেন, পরিচালকদের একটি অংশ অভিষেক বন্দোপাধ্যায়ের শরণাপন্ন হয়েছিলেন স্বরূপের বিরুদ্ধে লড়তে নেমে ‘সাহায্য’ চেয়ে। যদিও আনুষ্ঠানিক ভাবে এর কোনও ‘সমর্থন’ মেলেনি।
আরজি কর-কাণ্ড নিয়ে আন্দোলনের সময় থেকেই নবান্নের সঙ্গে টালিগঞ্জের একটি অংশের ‘দূরত্ব’ বাড়তে থাকে। কারণ হিসেবে তৃণমূলের এক নেতা কড়া মন্তব্যই করেছেন, ‘‘এরা শুধু নিজেদের দিকটাই দেখে!’’ এক ধাপ এগিয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণ, ‘‘সরকারকে শুধু মনে পড়ে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা নেওয়ার সময়।’’
যদিও সরকারের থেকে ‘সুযোগ-সুবিধা’ না-নেওয়ার উদাহরণও কম নয়। টালিগঞ্জের অনেক শিল্পী আছেন, যাঁরা সরকারের ‘ঘনিষ্ঠ’ নন। বা সরকারি অনুষ্ঠানে কোনও ভূমিকা পালন করেন না। ঘটনাচক্রে, আরজি করের আন্দোলন চলাকালীন কয়েক জন শিল্পী রাজ্যে সরকারি পুরস্কার এবং খেতাবও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা ‘পরিচিত’ তৃণমূল তথা বর্তমান সরকারের বিরোধী।
এই আবহেই শুক্রবার ‘বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন’-এর প্রস্তুতি বৈঠক উপলক্ষে আলিপুরের ‘সৌজন্য’ গৃহে একটি বৈঠক ডেকেছে রাজ্য সরকার। সেখানে উপস্থিত থাকবেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, সেখানে আমন্ত্রিতদের তালিকায় টালিগঞ্জের শিল্পীদের ‘বাড়াবাড়ি’ নেই। তবে সূত্রের খবর, অভিনেতা দেবকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তিনি অবশ্য তৃণমূলের সাংসদ। প্রশাসনিক স্তরের একটি সূত্রের বক্তব্য, প্রথমে যখন অনুষ্ঠানটির পরিকল্পনা করা হয়, তখন ঠিক হয়েছিল, বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনের প্রস্তুতি বৈঠকের পাশাপাশিই বাৎসরিক বিজয়া সম্মিলনীও করা হবে। দ্বিতীয় অনুষ্ঠানটিতে বরাবরই টলিউড এবং টেলিউডের কলাকুশলীদের বড় অংশ আমন্ত্রিত থাকেন। পরে ঠিক হয়, আমন্ত্রিতের তালিকা ‘সীমিত’ রাখা হবে। একই ‘মডেল’ রাখা হচ্ছে আসন্ন কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রেও। চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে মমতাই প্রথম নন্দনের ‘ঘেরাটোপ’ থেকে বাইরে এনে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে শুরু করেছিলেন। এ বার সেই অনুষ্ঠান করা হবে আলিপুরের ‘ধনধান্য’ প্রেক্ষাগৃহে। সেখানে স্থান সঙ্কুলান কম। ফলে ‘গণহারে’ আমন্ত্রণও জানানো হবে না। বেছে বেছে আমন্ত্রণপত্র পাঠানো হবে। সূত্রের খবর, সেখানেও কাটছাঁট হবে টলিউডের অতিথি তালিকায়।
এই দুই ইঙ্গিতেই ‘বুঝদার’ লোকেরা বুঝতে পারছেন যে, মমতা সচেতন ভাবে ওই ‘দূরত্ব’ বজায় রাখতে চাইছেন। সরকার এবং শাসকদলের প্রথম সারির অনেকেরই বক্তব্য, আরজি করের ঘটনায় তৈরি নাগরিক ক্ষোভে বাড়তি ‘অক্সিজেন’ দিয়েছিল তারকাদের একাংশের ভূমিকা। যা নিয়ে শাসক শিবিরেও ক্ষোভ এবং অনুযোগ কম ছিল না।
উল্লেখ্য, ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই অভিনেতা-অভিনেত্রীদের জনপ্রতিনিধি করার রেওয়াজ শুরু করেছিলেন মমতা। ২০১১ সালে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটে বীরভূমে মমতা প্রার্থী করেছিলেন অভিনেত্রী শতাব্দী রায়কে। তার পরে চিরঞ্জিত চক্রবর্তী, সোহম চক্রবর্তী, কাঞ্চন মল্লিক, রাজদের বিধানসভায় পাঠানো থেকে মুনমুন সেন, সন্ধ্যা রায়, নুসরত জাহান, মিমি চক্রবর্তীদের লোকসভায় পাঠিয়েছিলেন মমতা। ছ’মাস আগের লোকসভা ভোটেও রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়, সায়নী ঘোষ, জুন মালিয়াদের টিকিট দিয়ে সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছিলেন তৃণমূলনেত্রী। তাঁরা জিতে সাংসদও হয়েছেন। রাজনীতি থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত ঘোষণার পরেও খানিকটা মমতার কথা রাজি হয়েই ২০২৪-এর লোকসভা ভোটে আবার ঘাটালে দাঁড়াতে রাজি হয়েছিলেন দেব।
সাধারণ ভাবে শিল্পীদের জনপ্রতিনিধি করা তুলনায় ‘নিরাপদ’। প্রথমত, তাঁদের নিজস্ব জনপ্রিয়তাকে ভোটের ময়দানে ব্যবহার করা। দ্বিতীয়ত, তারকাদের প্রার্থী করে বিভিন্ন কেন্দ্রের প্রার্থী হওয়া নিয়ে দলের অন্দরের লড়াইকে থামিয়ে দেওয়া। তৃতীয়ত, তারকারা সরাসরি রাজনীতির লোক না-হওয়ায় কখনও দলীয় গোষ্ঠীতে জড়ান না। দলের অন্দরে ক্ষমতার সমান্তরাল ‘ভরকেন্দ্র’ তৈরি হয় না। চতুর্থত, তারকারা ভোটের রাজনীতিতে এসে আর্থিক দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন, এমন উদাহরণও বিশেষ পাওয়া যায় না। এই সমস্ত দিক বিবেচনা করেই শিল্পীদের রাজনীতিতে নিয়ে আসে প্রথাসিদ্ধ রাজনৈতিক দলগুলি। কিন্তু পাশাপাশিই দলের অন্দরে ক্ষোভও তৈরি হয় জনপ্রতিনিধি হিসাবে তাঁদের ‘কার্যকলাপ’ নিয়ে। সংসদ বা বিধানসভায় তাঁদের হাজিরা অনিয়মিত থাকে। ব্যতিক্রম থাকলেও অনেকের নির্বাচনী কেন্দ্র তাঁদের ‘নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগ’ থেকে বঞ্চিত থাকে। যে কারণে অনেকেই তাঁদের ‘ফুলদানি’ বলে অভিহিত করে থাকেন। অর্থাৎ, তাঁরা কেবল ‘শোভাবর্ধন’ করতে পারেন। কাজের কাজ নয়।
শুক্রবারের ‘সৌজন্য’ বৈঠক এবং চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন তৃণমূলের একটা বড় অংশ। তাঁদেরই এক জনের কথায়, ‘‘দিদির মনে এখন একটাই রিংটোন বাজছে— বন্ধু তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও। সেই মতোই ‘সাথী’ চেনার প্রক্রিয়া চলছে।’’