• কদর নেই হাতে তৈরি শিল্পের, স্বল্প সময়ে যোগানে আয় বেশি, ছাঁচ নির্ভরতা বাড়ছে ঘূর্ণির মৃৎশিল্পীদের
    বর্তমান | ২৯ নভেম্বর ২০২৪
  • দীপন ঘোষাল, রানাঘাট: শিল্প ও সময়ের দ্বন্দ্বে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে ঘূর্ণির অহঙ্কার। গতি সর্বস্ব সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে শিল্পসৃষ্টিতে দখল করছে ছাঁচ। ফলে, এতদিন ঘূর্ণির যে সব দক্ষ শিল্পীদের হাতের কারুকাজে নিরাকার কাদমাটি জীবন্ত শিল্প হয়ে উঠত, সেগুলি এখন ছাঁচ নির্ভর শিল্প হয়ে গিয়েছে। শিল্পীদের ঘরে ঘরে ছাঁচে তৈরি হচ্ছে পুতুল, মূর্তি সহ একাধিক মৃৎশিল্প সামগ্রী। 


    জগতজোড়া খ্যাতি রয়েছে কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পের। এ শহরের মাটির পুতুল যেন কথা বলে! ঘূর্ণিতে এই মৃৎশিল্পের গোড়াপত্তন নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কথিত, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এই শিল্পের সূচনা করেন। তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার নাটোর থেকে মৃৎশিল্পীরা কৃষ্ণনগরে এসে মাটির পুতুল তৈরি করতে শুরু করেন। ক্রমেই তা বিশ্বের দরবারে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু আজকের চূড়ান্ত ব্যস্ত যুগের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গিয়ে শিল্পসৃষ্টির তাল কাটছে ঘূর্ণিতে। কম টাকায় দ্রুত সব কিছু পেতে মুখিয়ে রয়েছে সবাই। তাই, শিল্পীরাও প্রতিযোগিতায় নেমেছেন সেই চাওয়ার সঙ্গে তাল মেলাতে। শিল্পীদের কথায়, এখন শিল্পের দাম কমেছে। হাতে তৈরি মাটির পুতুল অনেক বেশি দৃষ্টিনন্দন হলেও তার মূল্য মেলে না। বর্তমান ক্রেতাদের একটা বড় অংশই খোঁজ করেন সস্তা শিল্পের। অগত্যা, চাহিদা মতো জোগান দিতে ছাঁচ বানিয়ে চটজলদি মূর্তি বানিয়ে নেওয়ার চল শুরু হয়েছে কৃষ্ণনগরে। 


    ফলে, ঘূর্ণির মৃৎশিল্পের দোকানগুলিতে থরে থরে সাজানো ছাঁচ। হাতে সৃষ্ট মাটির পুতুল কেবলই প্রদর্শনীতে। ঘূর্ণির নামকরা শিল্পী তড়িৎ পাল। তাঁর নিজস্ব দোকান রয়েছে। পেয়েছেন রাষ্ট্রপতি পুরস্কার। তাঁর দোকানের এক্সিবিশন বক্সে রাখা হাতে তৈরি মাটির পুতুলগুলি যেন জীবন্ত! সেই শিল্পীসত্ত্বা হারিয়ে শিল্পীদের কেন এখন ছাঁচ নির্ভরতা? তড়িৎবাবুর দাদা তথা অন্যতম শিল্পী বিপ্লব পাল বলছিলেন, ‘প্রথমত, হাতে তৈরি মূর্তির জন্য সময় দিতে হয়। আজকের ক্রেতারা সেই সময় দিতে চান না। তার উপর একটি মাঝারি মাপের দৃষ্টিনন্দন পুতুল অথবা মূর্তি তৈরি করতে যে সময় যায়, তার দাম হতে পারে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। স্বাভাবিকভাবেই এমন ক্রেতা পাওয়া আজকের দিনে মুশকিল। সস্তায় মাটির পুতুল বিক্রি হয়। তাই, বাধ্য হয়েই এখানকার শিল্পীদের মধ্যে ছাঁচ নির্ভরতা বেড়েছে। এছাড়াও কম সময়ে অনেক মূর্তি তৈরি করা যায়। চাহিদা অনুযায়ী যোগান দেওয়া যায়।’ তবে, ছাঁচে মূর্তি তৈরি করলেও শিল্পীদের সৃষ্টিসত্ত্বা হারিয়ে যাবে না বলে মনে করেন বিপ্লববাবু। 


    কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা তথা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অমিত বিশ্বাস বলেন, ‘চাহিদা অনুযায়ী দ্রুত যোগান দিতে গেলে ছাঁচ ছাড়া কোনও গতি নেই। এখন সব জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। সংসার চালাতে হিমশিম শিল্পীরাও। তাই, যিনি কমসময়ে বেশি মৃৎশিল্প সামগ্রীর যোগান দিতে পারবেন তাঁর আয় বেশি হবে। সেই সুযোগ এনে দিয়েছে ছাঁচ। দেখা যায়, একটি বড় ফ্রেমে যদি দুর্গা মূর্তি হাতে তৈরি হয়, তার দাম উঠবে লাখ টাকা পর্যন্ত। এই দাম মধ্যবিত্তের আয়ত্তের বাইরে। তাঁরা ঘূর্ণিতে এসে স্মৃতি হিসেবে সস্তায় কিছু নিয়ে যেতে চান।’ অতঃপর, ক্রেতাদের মন বুঝে যোগান দিতে গেলে ছাঁচ ছাড়া উপায় নেই।  নিজস্ব চিত্র
  • Link to this news (বর্তমান)