চম্পক দত্ত: বন্যায় ভেঙেছে সাঁকো! গ্রাম পঞ্চায়েতের তৈরি নদী পারাপারের একমাত্র পথ-- কাঠের সেতু। এর একাংশ ভেঙেছে, যা এখনও মেরামত হয়নি। ভাঙা সাঁকোর পাশেই ঝুঁকি নিয়ে চলছে নৌকাপারাপার। এবার ফসল তোলা ও চাষের মরসুমেও চরম দুর্ভোগে কৃষকেরা।
দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে পাকা সেতুর দাবিতে আবেদন-নিবেদন জানিয়েও আজও অধরা সেই বহু-ঈপ্সিত ব্রিজ। জমি অধিগ্রহণের জন্য ৪ বছর আগে জেলায় চিঠি এলেও, তা পড়েছিল বলেই খবর। অবশেষে সেই চিঠি ব্লক প্রশাসনের হাতে আসতেই ব্লক অফিসে জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত বৈঠক হয়েছে বলে জানান বিডিও। সেতু নির্মাণের জন্য তৎপর হোক প্রশাসন, দাবি এলাকাবাসীর।
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার চন্দ্রকোনা-২ নম্বর ব্লকের ভগবন্তপুর-১ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের চৈতন্যপুরে শিলাবতী নদীর উপর কাঠের সেতু নির্মাণ করেছিল গ্রাম পঞ্চায়েত। নদী পারাপারে এই সেতুর উপর নির্ভরশীল চৈতন্যপুর, কেশেডাল, নিশ্চিন্তপুর, পরমানন্দপুর, পাঁচামি, ঘোষকিরা, ধর্মপোতা, কৃষ্ণপুর-সহ ২০-২৫ গ্রামের বাসিন্দারা। ভগবন্তপুর-১ ও ভগবন্তপুর-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের সংযোগস্থাপন করে কাঠের সেতুটি। এছাড়াও নদী পেরিয়ে যাতায়াত করতে হয় স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল থেকে বাজারহাটের জন্য। কৃষিকাজের জন্যও যাতায়াত করতে হয় এলাকার কৃষকদের।
গত বন্যায় শিলাবতীর জলের তোড়ে ভেঙে গিয়েছে কাঠের সেতুর একাংশ, নদীতে জল থাকায় ভাঙা সেতুর পাশেই ঝুঁকি নিয়ে চলছে নৌকায় যাতায়াত। চাষের মরসুম ধান তুলে আলু চাষ শুরু হয়েছে এলাকায়, চাষের সামগ্রী বাজার থেকে কিনে বাড়ি নিয়ে যেতে ভরসা নৌকা, তাতে চরম দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে কৃষকদের। চাষের সামগ্রী ট্রাক্টরে করে নদীর জল পেরিয়ে নিয়ে যেতে গিয়ে দুর্ঘটনাও ঘটেছে, নদীর জলে ডুবে গিয়েছে একটি ট্রাক্টর। তাকে উপেক্ষা করেই চাষের সামগ্রী নিয়ে নদীর জলে ডুবে ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করছে ট্রাক্টর। এককথায় নিত্যযাত্রী থেকে এলাকার কৃষকদের নদীপারে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে বলে দাবি তাদের।
আর এতেই ক্ষোভে ফুঁসছেন এলাকার বাসিন্দারা। দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে শুনে আসছে তাদের এলাকায় ব্রিজ হবে কিন্তু আজও তা অধরা। পঞ্চায়েত, বিধানসভা হোক কিংবা লোকসভা ভোট, ভোট এলেই সব রাজনৈতিক দলের মুখে ব্রিজ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতির বন্যা বয়, কিন্তু ভোট মিটলেই আর কারও তৎপরতা দেখা যায় না, অভিযোগ এলাকাবাসীর। প্রতি বছর বর্ষায় নদীর জল বাড়লেই যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, বন্যা হলে তো দুর্ভোগের শেষ থাকে না-- এমনই জানাচ্ছেন ভুক্তভোগী এলাকাবাসী। জানা গিয়েছে, ১৯৮০ সাল থেকে ব্রিজের দাবিতে বিভিন্ন দফতরে আবেদন-নিবেদন করে আসছে এলাকাবাসী, ব্রিজের দাবিতে একাধিক বার আন্দোলনও হয়েছে এলাকায়। তার ফল স্বরূপ বেশ কয়েকবার পূর্ত দফতরের টিম এলাকায় গিয়ে সার্ভে করে, পরবর্তী সময়ে ব্রিজ-সংলগ্ন নদীর দুই পাড়ে সংযোগকারী পিচ রাস্তা তৈরি হলেও ব্রিজ নির্মাণে কোনো প্রশাসনিক তৎপরতা চোখে পড়েনি।
এলাকার এক বাসিন্দা পাকা ব্রিজের দাবিতে অন্যতম পিটিশনার দুলাল বাগ জানান, নদীর দুই পাড়ে ব্রিজ-সংলগ্ন অ্যাপ্রোচ রোড তৈরি হয়েছে। কিন্তু ৮০-র দশক থেকে আমাদের দাবি, নদী পারাপারে পাকা ব্রিজ নির্মাণ, এ নিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থেকে প্রশাসন তৎপরতা দেখায়নি। আমরাই একাধিক বার জেলা থেকে রাজ্য বিভিন্ন দফতরে তাগাদা দিয়েছি। ২০২০ সালে রাজ্য থেকে জেলায় একটি চিঠি পাঠানো হয় জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত বিষয়ে, কিন্তু সেই চিঠি জেলাতেই পড়েছিল ব্লকে পাঠানো হয়নি। ব্রিজ নির্মাণে অগ্রগতির খোঁজ নিতে গিয়ে আমরা তা জানতে পারি। এ নিয়ে জেলায় খোঁজ খবর নেওয়ার পর সম্প্রতি জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত সেই চিঠি জেলা থেকে ব্লকে পাঠানো হয়েছে। ব্লকের বর্তমান বিডিও চিঠি হাতে পেয়ে ব্রিজ নির্মাণে উদ্যোগী হয়েছেন। ইতিমধ্যে বিডিও অফিসে জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত একটি বৈঠকও হয়েছে বলে জানান দুলালবাবু।
এ বিষয়ে চন্দ্রকোনা ২ ব্লকের বিডিও উৎপল পাইক জানিয়েছেন, "জেলা প্রশাসনের থেকে সম্প্রতি আমরা একটা চিঠি পেয়েছি জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত। ব্লক প্রশাসন ছাড়াও পূর্ত দফতর, বিএলআরও, ল্যান্ড অ্যাকুইজিশন, কৃষি দফতরকেও এই চিঠি পাঠানো হয়েছে। সবাইকে নিয়ে ইতিমধ্যে দুটি বৈঠক করা হয়েছে। বিএলআরও দফতরকে নিয়ে পূর্ত দফতর সরাসরি জমি অধিগ্রহণ করবে, তার আগে সার্ভের কাজটা করতে হবে সবাইকে নিয়ে। আমরা আরও একবার সবাইকে নিয়ে বৈঠকে বসব। এই মুহূর্তে আবাস যোজনার সমীক্ষার কাজ চলছে ব্লকে, আবাস যোজনার সমীক্ষার কাজ শেষ হলে ব্রিজ ও ব্রিজ-সংলগ্ন জমি অধিগ্রহণের সার্ভের কাজটা শুরু করে দেব আমরা। "আপাতত, নদীতে জল রয়েছে, জল কমলে স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েতকে দিয়ে কাঠের সেতুর ভাঙা অংশটা মেরামত করে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে, যাতে ওই সেতু দিয়ে যাতায়াত করা যায়। এমন আশ্বাসই দিয়েছেন বিডিও। সেই ৮০-র দশক থেকে দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে নদী পারাপারে দুর্ভোগ থেকে রেহাই পেতে শিলাবতী নদীর উপর ব্রিজের অপেক্ষায় এলাকাবাসী।