কিশোরীর দেহে ১৭তম অস্ত্রোপচার মেডিক্যালে, ছিল না পৃথক মল, মূত্র ও যোনিদ্বার
বর্তমান | ০১ ডিসেম্বর ২০২৪
বিশ্বজিৎ দাস, কলকাতা: মেডিক্যাল কলেজের ইডেন বাড়ির ক্যানিং ওয়ার্ড। বেডের সঙ্গে প্রায় মিশে গিয়েছে ছোটখাটো শরীরটা। মা সাহেবা বিবির (নাম পরিবর্তিত) মুখচোখ-মন সবটাই নিবিষ্ট মেয়ের দিকে। রাইস টিউব লাগানো আছে বলে কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে মেয়ের। অব্যক্ত কষ্ট নিয়ে বারবার মায়ের দিকে তাকাচ্ছে রেশমা (নাম পরিবর্তিত)। বলতে চাইছে, টিউবটা খুলে দিলে হয় না! কিশোরীর কষ্ট বুঝলেন চিকিৎসকরা। বুঝলেন মায়ের বেদনাও। ধীরে ধীরে বের করে আনা হল রাইস টিউব। এতক্ষণে মুখে হাসি ফুটল মুর্শিদাবাদের এই অসমসাহসী মেয়ের।
যখন সে জন্মেছিল, ওপরওয়ালা কী ভেবেছিলেন, কে জানে! তবে এ মেয়ে যে সহ্যশক্তি ও লড়াই করার অবিশ্বাস্য ক্ষমতায় যাবতীয় ঝড়ঝাপটা সামলেই বড় হবে, ললাটলিখন বোধ হয় সেটাই ছিল। জন্মের তিনদিনের মাথায় তাঁর শরীরে প্রথম অস্ত্রোপচার হয়। ১৫ বছরের রেশমার শরীরে গত বৃহস্পতিবার হল ১৭তম অপারেশন! যা তৈরি করল নতুন ইতিহাস।
শনিবার মেডিক্যাল কলেজের পেডিয়াট্রিক সার্জারি এবং স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যার চিকিৎসকরা বলেন, ‘জন্ম থেকেই রেশমার মল, মূত্র এবং যোনিদ্বার ছিল একটিই। ডাক্তারি পরিভাষায় একে বলে ক্লোয়াকাল ম্যালফরমেশন। অতিবিরল এই সমস্যা প্রতি ৫০ হাজার প্রসবে একটি শিশুর ক্ষেত্রে দেখা যায়। রেশমার বয়স যখন তিনদিন, তখন প্রথম অপারেশন করে পেটে তৈরি করা হয় কৃত্রিম মলদ্বার। ২ বছর বয়সে স্থায়ী মলদ্বার তৈরি করা হয়। বন্ধ করা হয় আগেরটি। কিন্তু যোনিপথ এবং রেচনপথ একটিই থেকে যায়। ১৪ বছর বয়স হতেই দেখা দেয় নতুন বিপদ। ফুলে যাওয়া পেট, তীব্র অস্বস্তি আর ধুম জ্বরে ভোগা সেই মেয়েকে নিয়ে মেডিক্যালে ছুটে আসেন মা। পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখা যায়, পিরিয়ডের রক্ত বেরতে না পারায় তা জমতে শুরু করেছে শরীরে। তলপেট, যোনিপথ দিয়ে ফিসচুলার মাধ্যমে সেই রক্ত ও পুঁজ বেরতে শুরু করেছে। এ সমস্যা জীবনমরণের। কারণ, রক্ত ও পুঁজ জমতে দিলে মেয়েটি স্রেফ সেপটিসেমিয়া হয়ে ইনফেকশনে মারা যাবে। এবারে তার চিকিৎসার দায়িত্ব নিলেন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা। তৈরি হল মেডিক্যাল বোর্ড। মিলল অস্ত্রোপচারের অনুমতি। দেখা গেল, আরও একটি বিরল কাণ্ড হয়ে আছে। শুধুমাত্র একদিকেই ফ্যালোপিয়ান টিউব ও ডিম্বাশয় আছে তার শরীরে। জরায়ুতেও রয়েছে জন্মগত সমস্যা।
এরপর পেডিয়াট্রিক সার্জারির প্রধান ডাঃ সুজয় মৈত্র, গাইনির সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ পার্থসারথি মিত্র, ডাঃ সৌমি বিশ্বাস, ডাঃ রমাকান্ত মজুমদার সহ দুই বিভাগের চিকিৎসকরা সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নেন, আগে প্রাণ বাঁচাতে হবে মেয়েটির। সেক্ষেত্রে মেয়েটি ভবিষ্যতে সন্তানসম্ভবা হতে পারবে না। বাড়ির লোকজনকে জানানো হল সেকথা। তাঁরা সাফ জানালেন, যেভাবেই হোক, রেশমা বাঁচুক সুস্থভাবে। অবশেষে বৃহস্পতিবার জরায়ু বাদ দেওয়া হয় তার শরীর থেকে। সফল হয় ১৭তম অপারেশন। ক্যানিং ওয়ার্ডে তখন শীত-সকালের উজ্জ্বল রোদ্দুর। ভবিষ্যতে শিক্ষক হতে চাওয়া রেশমা আপাতত বাড়ি ফিরে জড়িয়ে ধরতে চায় তার আড়াই বছরের ছোটবোনকে।