লাল সূর্যটা টুপ করে ডুবে যেতে বসেছে গাছপালার পিছনে। আলো গুটিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ওঁদের বুক কাঁপতে শুরু করে। চেপ্টি শৈব আর ফুলমণি ওঁরাওয়ের।
আলিপুরদুয়ারের মাদারিহাট ব্লকের মধ্য খয়েরবাড়ির বাসিন্দা দুই মহিলা। দু’জনেরই স্বামী মারা গিয়েছেন বেশ কয়েক বছর আগে। এককথায় অসহায়। চেপ্টি সন্তানহীন। ফুলমণির একমাত্র ছেলে শ্রমিক। এলাকাটি জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানের ধুমচি বনাঞ্চল সংলগ্ন। তাই বেলা পড়তেই ওই জনপদের দখল নেয় বুনো হাতিরা। তবে হস্তিকুলের যেন টার্গেট হয়ে দাঁড়িয়েছে চেপ্টি ও ফুলমণির দরমার দু’টি বাড়ি।
গত পাঁচ বছরে চেপ্টির ঘর ২০ বার ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে বুনো হাতি। আর ফুলমণির ঘর ভেঙেছে ২২ বার। দুই বাড়ির উঠোনের মাটির মেঝেতে গোদা পায়ের চিহ্ন বলে দেয় যে, কতটা আক্রোশ থাকলে বেছে বেছে ২০০ মিটার দূরত্বের দু’টি বাড়িকেই টার্গেট করে বুনো হাতিরা। অগত্যা প্রাণ বাঁচাতে ঠাঁইবদল করতে হয়েছে পাঁচ বছর ধরে।
স্থানীয় মধ্য খয়েরবাড়ি আইটিডিপি প্রাথমিক স্কুলের একতলা ঘরে বাস করতে বাধ্য হচ্ছেন ওই দুই প্রৌঢ়া। অভিযোগ, পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে প্রশাসনের কাছে কাছে বছরের পর বছর ধরে মাথা ঠুকেও সমাধান মেলেনি।
রোজই বিকেল পাঁচটা বাজতেই রান্নাবান্না, খাওয়াদাওয়া সেরে দু’জনকে ছুটতে হয় প্রাথমিক স্কুলে। রোজ হাতি আসে। আসেই। একতলার বারান্দা থেকে তাঁরা দেখেন, ঠিক কীভাবে বুনো হাতির দল অজানা আক্রোশ মেটায় তাঁদের বাড়ি দু’টির ওপর। কেন এমন অদ্ভুত আচরণ? বিশিষ্ট হস্তিবিশারদ পার্বতী বড়ুয়া বলেন, ‘আমি নিশ্চিত যে ওই বাড়ি দু’টির অবস্থান হাতিদের স্বীকৃত করিডরের উপর। সেই কারণে চলাফেরায় বাধা পেয়ে বেছে বেছে ওই বাড়ি দু’টিকেই টার্গেট করে বুনো হাতিরা। অথবা ওই বাড়ির সদস্যরা কখনও কোনও ভাবে হাতিদের উত্যক্ত করেছিলেন।’
যদিও হাতিদের বিরক্ত করার কথা স্বীকার করেন না চেপ্টি। বলেন, ‘কখনও এমনটা করিনি। উল্টে মহাকাল বাবাকে পুজো করি। কিন্তু কিছুতেই আমাকে ওরা ক্ষমা করছে না। আমাদের বিকল্প বাসাও কেউ দিল না।’ ফুলমণি ওঁরাওয়ের কথায়, ‘ছেলে ও বউমাকে নিয়ে স্কুল ঘরে ছুটতে হয় রোজ বিকেলে। আমাদের কেউ দেখে না। অথচ ভোটের সময় সবাই ছুটে আসে আর আশ্বাস দেয়। এই ভাবে পাঁচ বছর পার হয়ে গেল।’
স্থানীয় পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী সুপেন দাস হাতি তাড়াতে আসেন বনকর্মীদের সঙ্গে। বলেন, ‘আমারও ধারণা, করিডরের মধ্যে পড়ায় হাতিরা এমন আচরণ করে। যদি বিশেষ আকৃতির পাকা ঘর তৈরি করা যায়, তা হলে সমস্যা মিটতে পারে। এর নীচ দিয়ে অবাধে হাতিরা যাতায়াত করতে পারবে, বাধা পাবে না। বাড়িও বাঁচবে।’ এলাকার তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্য কিশোর মুন্ডার বক্তব্য, ‘বনের ধারে আমাদের বাস, তাই চিন্তা বারোমাস। রাত নামতেই ৩০–৪০টি হাতি দৈনিক গ্রামে এসে হানা দেয়। ফসল খায়। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে ওই দু’টি বাড়িকেই ভাঙে। আবাস যোজনার টাকা না আসায় কিছু করা যাচ্ছে না।’