• শুঁটকিতে ভর করেই লক্ষ্মীলাভ অপরাজিতার
    এই সময় | ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪
  • সঞ্জয় চক্রবর্তী, শিলিগুড়ি

    শুঁটকি। নামটা শুনলেই অনেকেই নাক কোঁচকান। আবার যাঁরা পছন্দ করেন, তাঁদের কাছে এটা অত্যন্ত সুস্বাদু খাবার। পুষ্টিদায়কও বটে। এবং স্রেফ শুঁটকি রান্না করেই একটা জমজমাট ব্যবসা শুরু করাও সম্ভব। কী, বিশ্বাস হচ্ছে না? আসুন, আপনাদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই অপরাজিতা দত্তের।

    শিলিগুড়ির ভারতনগরের বাসিন্দা অপরাজিতা বাড়িতেই খুলেছেন ক্লাউড কিচেন। সকাল থেকে বাড়িতে রান্না হয় শুঁটকির নানা পদ। দুপুর থেকে বাড়ির সামনে ভিড় করেন জ়োম্যাটো কিংবা সুইগির ডেলিভারি বয়েরা। শহর শিলিগুড়ি তো আছেই, লাগোয়া মাটিগাড়া, শিবমন্দির, বাগডোগরাতেও চলে যাচ্ছে শুঁটকির হরেক কিসিমের পদ। লোকজনও পরম তৃপ্তিতে চেটেপুটে খাচ্ছেন। উপরি পাওনা, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশংসার বন্যা।

    বছর তিনেক আগে ক্লাউড কিচেন করেছেন অপরাজিতা। ইতিমধ্যেই তাঁর গ্রাহকের সংখ্যা পঞ্চাশ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে। উত্তরবঙ্গে এমনিতেই ঢের শুঁটকিপ্রেমী আছেন। কারণ, রাজবংশী সম্প্রদায় ও পূর্ববঙ্গের লোকজনের কাছেও শুঁটকি একটি জনপ্রিয় খাবার। পূর্ববঙ্গের লোকজন দেশভাগের পরে উত্তরবঙ্গে নিজেদের ভাগ্য ফেরাতে এসে নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছেন।

    ফলে অপরাজিতার ব্যবসাও ক্রমশ ফুলেফেঁপে উঠছে। প্রথমে ছেলেকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরি থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এসে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। এখন সেই ব্যবসাতে অপরাজিতার স্বামী, ছেলে, মেয়ে, সকলেই যোগ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘যখন শুরু করেছিলাম তখন বুঝতে পারিনি আমার এই ছোট্ট ব্যবসার ভবিষ্যৎ কী! আজ মনে হচ্ছে, ভুল কিছু করিনি। তবে পরিষ্কার, পরিচ্ছন্নতা এবং রান্নার স্বাদের সঙ্গে আপস করি না।’

    লকডাউন বহু মানুষের জীবিকা কেড়ে নিয়েছে। আবার অনেকে লকডাউনের পরে নতুন জীবিকার সন্ধানও পেয়েছেন। লকডাউনের আগে অপরাজিতা সংসার সামলে সামান্য পুঁজির ছোট ব্যবসা করতেন। সেই ব্যবসায় দৌড়াদৌড়ি করতে হত ভীষণ। কিন্তু সেই তুলনায় আয় তেমন ছিল না। লকডাউন অপরাজিতার সেই ব্যবসাও কেড়ে নেয়। ঘরে বসে বসে দেখতেন, মানুষের হাতে টাকা থাকলেও ঘরে খাবার নেই। যাঁদের ঘরে খাবার আছে, তাঁদেরও অনেকেরই রান্না করার মতো শারীরিক সক্ষমতা নেই। স্রেফ সেবার মনোভাব নিয়েই লকডাউনে তিনি শুঁটকি বাটা রান্না করে লকডাউনের জেরে বিপাকে পড়া প্রতিবেশী বাড়িতে দিয়ে আসতেন। সকলেই অপরাজিতা ও তাঁর রান্নার প্রশংসা করতেন মুক্তকণ্ঠে। সেই প্রশংসা শুনতে শুনতেই অপরাজিতার মাথায় আসে— ‘এটাকেই ব্যবসা হিসেবে নিলে কেমন হয়!’

    লকডাউন শেষ হতেই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে ২০২১ সালের পুজোর পরে নেমে পড়েন ব্যবসায়। প্রথমে বাড়িতে যথেষ্ট জায়গা না থাকায় শিলিগুড়ির হাকিমপাড়াতে একটি দোকান ভাড়া নিয়ে ক্লাউড কিচেন খোলেন। সঙ্গে একফালি রেস্তোরাঁ। কিন্তু লোকজন জানালেন, শুঁটকি রেঁস্তোরায় খেয়ে জুত হচ্ছে না। বাড়িতে বসে গরম ভাতের সঙ্গে মেখে না খেলে কি শুঁটকির স্বাদ মেলে?

    তারপর থেকেই অপরাজিতা শুরু করেন হোম ডেলিভারি। বাড়িতে বড়সড় রান্নাঘর, আউটলেট তৈরি হয়ে যাওয়ায় ভাড়ার দোকান ছেড়ে ভারতনগরেই ফিরে এসেছেন তিনি। অপরাজিতার ছেলে শুভম বলেন, ‘মায়ের ব্যবসা দাঁড়িয়ে যেতেই আমি ফের চাকরিতে যোগ দিয়েছি। তবে সময় পেলেই মাকে সাহায্য করি। সময় পেলে নিজেই গ্রাহকদের খাবার পৌঁছে দিই। আসলে মায়ের এই ব্যবসার হাত ধরে এত মানুষের ভালোবাসা পাচ্ছি যে এড়ানো কঠিন।’
  • Link to this news (এই সময়)