• রানওয়ে দাপাচ্ছে দাঁতাল! যবনিকা মধ্যরাতে
    এই সময় | ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪
  • রাহুল মজুমদার, শিলিগুড়ি

    মাত্র আড়াই ঘণ্টা আগে এখান থেকে উড়ে গিয়েছে দিনের শেষ ফ্লাইট। ইন্ডিগোর বাগডোগরা–কলকাতা উড়ান। তখন কে–ই বা ভেবেছিল, নৈশভ্রমণে বেরিয়ে পথ হারিয়ে টেক–অফের সেই রানওয়েতেই দৌড়ে বেড়াবে একটি দাঁতাল হাতি! আর তাকে বাগে আনতে শীতের রাতে প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টা ধরে পটকা আর ট্র্যাঙ্কুলাইজ়ার হাতে দৌড় চলবে বনকর্মীদের।

    রবিবার রাতে এমনই দৃশ্যের সাক্ষী রইলেন বাগডোগরা বিমানবন্দরের অফিসার–কর্মী এবং ভারতীয় বায়ুসেনার আধিকারিকরা। বাগডোগরা বিমানবন্দর অসামরিক প্রয়োজনে ব্যবহার করা হলেও মূলত এটি থাকে ভারতীয় বায়ুসেনার দায়িত্বে। সেখানে বেশ কিছু কপ্টার ও যুদ্ধবিমানও রাখা থাকে।

    এমন একটি বিমানবন্দরের রানওয়েতে রাত ৯টার পরে আচমকা হাতি ঢুকে পড়ায় পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন বায়ুসেনার অফিসাররাও। কারণ রানওয়েতে ঘোরাঘুরি করে সে চলে যায় বায়ুসেনার বেসক্যাম্পের দিকে। এই পরিস্থিতিতে হাতির ধাক্কায় যদি একটি এয়ারক্র্যাফ্টেরও ক্ষতি হয়, তার অঙ্ক হবে বিরাট। একটা সময় পরে বনকর্মীদের তাঁরা মৌখিক ভাবে জানিয়েও দিয়েছিলেন, হাতিটিকে রানওয়ের আশপাশ থেকে সরানো না গেলে জাতীয় সুরক্ষার স্বার্থে কোনও ‘কঠোর সিদ্ধান্ত’ নিতে হতে পারে। একবার ঘুমপাড়ানি গুলিও ছুড়েছিলেন বনবিভাগের কর্মীরা, তবে তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য ‘কঠোর’ পথে হাঁটতে হয়নি কাউকেই। রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ পটকার শব্দেই রানওয়ে ছেড়ে বিমানবন্দরের দক্ষিণ দিকের গেট দিয়ে সংলগ্ন জঙ্গলের দিকে চলে যায় সে।

    এর আগে এবং পরেও কিন্তু নাটকের কয়েকটি অঙ্ক রয়েছে। ঘটনার সূত্রপাত শনিবার রাতে। শিলিগুড়ির আমবাড়ির কাছে বৈকন্ঠপুর জঙ্গল থেকে সাবঅ্যাডাল্ট দাঁতাল হাতিটি বেরিয়ে এশিয়ান হাইওয়ে দিয়ে হেঁটে ফুলবাড়ি হয়ে উত্তরকন্যার কাছে চলে আসে। সেখান থেকে স্যাটেলাইট টাউনশিপ, কামরাঙ্গাগুড়ি হয়ে এশিয়ান হাইওয়ে ধরে তিনবাত্তি চলে আসে সে। ওই জায়গা থেকে নৌকাঘাটের দিকে এসে বালাসন নদী পার হয়ে মাটিগাড়ার দিকে চলে যায় দাঁতাল। মাটিগাড়া থেকে লোকালয় হয়ে রবিবার গোঁসাইপুরে ঢোকে হাতিটি। দিনভর গোঁসাইপুর এলাকায় ঘুরে বেড়ায় ওই হাতিটি। খবর পেয়ে বন দপ্তরের কার্শিয়াং এবং বৈকন্ঠপুর ডিভিশনের ১৫টি স্কোয়াড এবং সুকনা ওয়াইল্ডলাইফ রেঞ্জের কর্মীরা এলাকায় হাজির হন। বিকেলের পরে ওই ১৫০ বনকর্মী হাতিটিকে জঙ্গলে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। রাত ৯টা নাগাদ হাতিটি বাগডোগরা বিমানবন্দরে ঢুকে পড়ে।

    বিমানবন্দর এলাকায় প্রথমেই পটকা ফাটাতে পারেননি বনকর্মীরা। বায়ুসেনার অনুমতি নিয়ে সে কাজ শুরু হয়। তাতেও পরিস্থিতি বাগে আসছিল না। খবর পেয়ে কার্শিয়াং থেকে ঘটনাস্থলে চলে আসেন ডিএফও দেবেশ পাণ্ডে। তিনিই বনকর্মী ও রেঞ্জারদের ১৫টি ইউনিটকে ভাগ করে রানওয়ে এলাকার আশপাশে পাঠান। রাত সাড়ে ১২টার পরে দাঁতালটি বিমানবন্দর এলাকা ছাড়ে। এয়ার ফোর্সের সাউথ ব্লকের গেট খুলে হাতিটিকে সেখান থেকে বের করা হয়। এরপর রাতেই তেতুলিয়ার কাছে বাংলাদেশ সীমান্ত হয়ে ফাঁসিদেওয়ার মোহাম্মদ বক্স এলাকা হয়ে ফুলবাড়ির দিক দিয়ে নদী পার করে হাতিটিকে ওই এলাকার একটি ফরেস্ট ল্যান্ডে রাখা হয়। হাতিটি যাতে আবার অন্য কোনও জায়গায় ঢুকে না–পড়ে, তা নিশ্চিত করতে সীমান্ত এলাকাতেও বিএসএফকে জানিয়ে পটকা ফাটায় বন দপ্তর।

    এই ঘটনার পরে পরিবেশকর্মীদের একাংশ প্রশ্ন তুলেছেন, কেন আগেই হাতিটিকে বৈকুণ্ঠপুরের জঙ্গলপথে ফেরাতে পারলেন না বনকর্মীরা। বিশেষজ্ঞ অনিমেষ বসুর বক্তব্য, ‘মূলত ধান খাওয়ার জন্য এই ধরনের ‘লোনার’ (একাকী) হাতিগুলি যেখানে সেখানে চলে যাচ্ছে। বন দপ্তরকে আরও কড়া নজর রাখতে হবে এবং দ্রুত এই হাতিটিকে জঙ্গলে ফেরানোর ব্যবস্থা করতে হবে।’ গোটা ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন উত্তরবঙ্গের প্রধান মুখ্য বনপাল (বন্যপ্রাণ)।
  • Link to this news (এই সময়)