• বাংলা নয়, অন্য ভাষার গান শোনাতে হবে! বলতে পারেন শ্রোতা? কী বলছেন শিল্পীরা
    আনন্দবাজার | ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪
  • একটা সময় ছিল, যখন শিল্পী প্রায় দেবতা রূপে পূজিত হতেন তাঁর অনুরাগীদের কাছে। ধরুন, মঞ্চে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বা মান্না দে। অথবা ষাট-সত্তর দশকের কোনও শিল্পী। প্রথমে তিনি তাঁর পছন্দের গান শোনাতেন। তার পর শ্রোতার আর্জি। অনেক সময় সেই অনুরোধের গান অন্য ভাষারও হত। শিল্পী হয়তো হাত তুলে বলতেন, “হবে হবে”। শ্রোতা খুশিমনে অপেক্ষায় থাকতেন। পছন্দের গান শোনার পর তাঁর মুখ আনন্দে ঝলমলে। এমন ঘটনার কথা সেই আমলের পত্রপত্রিকায় হামেশাই প্রকাশিত হত। সেই সময় শিল্পী-শ্রোতার এই আদানপ্রদান এতটাই আন্তরিক এবং শ্রদ্ধামিশ্রিত যে, আবদার বা অনুরোধেও তার ছায়া পড়ত।

    কাট টু, ২০২৪-এর ৭ ডিসেম্বর। ইমন চক্রবর্তী এক বহুজাতিক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার অনুষ্ঠানে গান গাইছিলেন। হঠাৎ এক শ্রোতা বলে ওঠেন, তিনি বাংলা গান শুনবেন না। হিন্দি গান গাইতে হবে। রীতিমতো কড়া ভাষায় নির্দেশ শিল্পীকে, “বাংলা শুনব না। হিন্দি গান গাইতে হবে, নাচব!” এই আবদার ‘মাচা’ বা শহরতলি, গ্রামে মঞ্চ বেঁধে যে অনুষ্ঠান হয় সেখানে হামেশাই শোনা যায়। তা বলে তথাকথিত প্রথম সারির প্রতিষ্ঠানে এই ধরনের নির্দেশ?

    ইমন তাঁর মতো করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেছেন, “আমরা যে শুধুই বাংলা গান গাই, তা কিন্তু নয়। যে হেতু সঙ্গীতশিল্পী তাই সব ভাষার গান গাইব। কিন্তু আমার ভাষাকে অসম্মান করা হলে সেটা মেনে নেব না।” তিনি আরও জানিয়েছেন, শুক্রবারের অনুষ্ঠানে ওই শ্রোতা অবাঙালি ছিলেন, তিনি নিশ্চিত। শিল্পীর খারাপ লাগার জায়গা অন্য। তাঁর কথায়, “যে ভঙ্গিতে ‘হিন্দি গানা গাইয়ে, নাচেঙ্গে’ বলেছেন, তাতে আমি অপমানিত।” পাল্টা প্রশ্ন ইমনের, “বাংলায় থাকছেন, রোজগার করছেন। অথচ এই ভাষার প্রতি নূন্যতম শ্রদ্ধা থাকবে না?”

    শিল্পীর এই বক্তব্য, এই অনুভূতিকে সমর্থন জানিয়েছেন টোটা রায়চৌধুরী, লোপামুদ্রা মিত্র, লগ্নজিতা চক্রবর্তী।

    বাংলাভাষী ক্ষোভে ফেটে পড়লে অনেককেই মাশুল গুনতে হবে...

    এই বক্তব্য টোটার। তিনি প্রশংসা করেছেন ইমনের সাহসের। কুর্নিশ জানিয়েছেন গায়িকার প্রতিবাদকে। বলেছেন, “অনুষ্ঠানে শিল্পীর কাছে পছন্দের গানের অনুরোধ রাখতেই পারি। কিন্তু হুকুম করতে পারি কি? বা বাংলায় দাঁড়িয়ে বলতে পারি কি, বাংলা গান শুনব না? মঞ্চে যিনি গাইছেন তিনি যে মূলত বাংলা গান গেয়েই জাতীয় স্তরে সম্মানিত, সেটা না জেনেই তাঁর প্রোগ্রাম দেখতে চলে এসেছি?”

    টোটা এখানেই থামেননি। তাঁর আরও বক্তব্য, “আমরাও অন্যান্য রাজ্যে, অন্য ভাষায় কাজ করি। সেখানে গিয়ে স্থানীয় ভাষার অপমান করি না। বরং বাঙালি অন্যের ভাষা বা সংস্কৃতির প্রতি অনেকটাই শ্রদ্ধাশীল, সহনশীল। প্রতিদানে সেই সম্মান অবশ্যই আমরাও আশা করব!” এই প্রসঙ্গে তাঁর একটি ঘটনা মনে পড়ছে। তিনি এক বার কন্নড় ছবির শুটিং করতে গিয়েছিলেন। সেই সময় আলোচনায় উঠে এসেছিল, কী ভাবে বেঙ্গালুরুতে বিভিন্ন অফিস তৈরির পর বাইরে থেকে আসা বেশ কিছু কর্মী স্থানীয় ভাষাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতেন। একটা সময়ের পর কন্নড়ভাষীরা এমন প্রতিবাদ জানান যে এখন কেউ আর কর্ণাটকে কন্নড় ভাষার বিরুদ্ধে একটিও শব্দ বলতে সাহস দেখায় না। সেই জায়গা থেকেই তাঁর হুঁশিয়ারি, “আমাদের নম্রতা বা ভদ্রতা আমাদের দুর্বলতা নয়। বাংলাভাষী ক্ষোভে ফেটে পড়লে অনেককেই মাশুল গুনতে হবে।”

    ‘লুঙ্গি ডান্স’ শোনাতে বলেছিল, ‘বেণীমাধব’ শুনিয়েছিলাম...

    এই অভিজ্ঞতা লোপামুদ্রা মিত্রের। তাঁর দাবি, এই ঘটনা নতুন কিছু নয়। গত ৩০ বছর ধরে শিল্পীদের এই অনুরোধ শুনে আসতে হচ্ছে। এই প্রসঙ্গে তিনি নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিয়েছেন। বলেছেন, “কলকাতার কোনও একটি সভাগৃহে গাইছি। হঠাৎ, শ্রোতাদের থেকে অনুরোধ, ‘লুঙ্গি ডান্স’ শোনান। আমি শুনিনি। বদলে ‘বেণীমাধব’ শুনিয়েছিলাম।” পাশাপাশি এ-ও জানান, অনেকে মেনে নেন। অনেকে নেন না। ইমন দ্বিতীয় দলে। তাই জোরালো প্রতিবাদ করতে পেরেছেন। সঙ্গে দুটো পথও বাতলে দিয়েছেন। গায়িকার দাবি, “প্রথমত, শিল্পীকে অনড় থাকতে হবে, তিনি বাংলা ছাড়া অন্য গান গাইবেন না। দুই, বাংলাতেও এমন কিছু গান তৈরি করতে হবে, যা শুনে শ্রোতারা নাচতে বাধ্য হন।” লোপামুদ্রার মতে, এই দুই পন্থা অবলম্বন করলে সমস্যা অনেক কমবে।

    বাংলা গান না শুনতে চাইলে অনুষ্ঠান করি না...

    এই পন্থা সোমলতা আচার্যের। তিনি জানিয়েছেন, অনুষ্ঠানের অনুরোধ এলে তাঁর দল আগে দেখে, কোথায় অনুষ্ঠান হচ্ছে। শ্রোতারা বাংলা গান শুনবেন কি না। কলকাতার অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে তাঁর কড়া নির্দেশিকা, বাংলা গান শুনতে না চাইলে তিনি অনুষ্ঠান করবেন না। রাজ্যের বাইরের অনুষ্ঠানে বাংলার পাশাপাশি গজ়ল বা ঠুংরি শোনান। তার পর বলেন, এর বাইরে কোনও হিন্দি গান তিনি জানেন না। সোমলতার কথায়, “ইমনের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা কমবেশি আমাদের সঙ্গেও ঘটেছে। প্রত্যেকে নিজের মতো করে প্রতিবাদ জানিয়েছি।” তাঁর মতে, নিজের শহরে মাতৃভাষা অপমানিত হলে সেটা সত্যিই গায়ে লাগার মতো।

    ঘটনার এক পিঠ যদি এমন হয়, তা হলে তার অন্য পিঠও আছে। পশ্চিমবঙ্গে শুধু বাংলা ভাষায় গান শুনতে হবে, এমন কোনও ফতোয়া জারি হয়েছে কি? শ্রোতার কি ইচ্ছেমতো গান শোনার অধিকার বা স্বাধীনতা নেই?

    বিয়েবাড়িতে যখন শিল্পী গান, তখন কি সবাই শোনেন?...

    ইমনের গান-বিতর্ক নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই পাল্টা প্রশ্ন রেখেছেন রুদ্রনীল ঘোষ। তিনি উপরে বলা প্রশ্নগুলো করেছেন। একই সঙ্গে বলেছেন, “যুগের হুজুগে কথা বলার ভঙ্গি বদলে গিয়েছে। গান এখন পণ্য। শ্রোতারা অর্থের বিনিময়ে শোনেন। আগেও সেটাই হত। কিন্তু তখন শিল্পীদের আলাদা কদর ছিল। মূল্য ছিল তাঁদের শিল্পের। এখন সেটা আর নেই।” কেন নেই? তারও উত্তর আছে তাঁর কাছে।

    রুদ্রনীলের কথায়, “আগেকার শিল্পীরা উপার্জনের কারণে বিয়েবাড়িতে গাইতেন না। একই ভাবে অভিনেতারাও মুখ দেখাতেন না সেখানে। ফলে, ওঁদের আলাদা সম্মান ছিল। এখন শিল্পীরা বিয়েবাড়িতে গাইছেন। এবং বিয়েবাড়ির হুল্লোড়ে চাপা পড়ে যাচ্ছে তাঁদের গলা। কেউ শুনছেন, কেউ শুনছেন না।” রাজনীতিবিদ-অভিনেতার প্রশ্ন, “তখন কি শিল্পী গান থামিয়ে দিচ্ছেন? ওটাও তো এক ধরনের অপমান!” তাঁর যুক্তি, সেটা শিল্পী মেনে নিলে এটাও তাঁকে মেনে নিতে হবে।

    রুদ্রনীলের ভাল বন্ধু ইমন। তিনি শিল্পীর গান পছন্দ করেন। তার মানে এই নয়, কেউ তাঁকে অন্য ভাষায় গান শোনানোর কথা বলতে পারবেন না। এ-ও জানিয়েছেন, অনুষ্ঠানের শুরুতে কেউ এই আবদার জানালে সেটা অবশ্যই অন্যায়। কিন্তু কয়েকটি গানের পর এই আবদার শ্রোতা রাখতেই পারেন। সেখানে কোনও অন্যায় তিনি দেখছেন না। বদলে তাঁর মত, “পরিস্থিতি এখন এটাই দাঁড়িয়েছে। গান আর শিল্প নেই, পণ্য। তাকে কোনও প্রতিষ্ঠান বা শ্রোতা কিনছে। ফলে, শ্রোতার নির্দেশ মেনেই গাইতে বা অভিনয় করতে হবে শিল্পীকে।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)