• ‘মেয়েদের সমস্যা’ বলে দাগিয়ে দেওয়াই কি লিঙ্গভিত্তিক হিংসা রোধের অন্তরায়
    আনন্দবাজার | ১০ ডিসেম্বর ২০২৪
  • এক তরুণী সরকারি হাসপাতালে নার্সের চাকরি পাওয়ায় ঘুমের মধ্যে মুখে বালিশ চেপে ধরে ডান হাত কব্জি থেকে কেটে নিয়েছে স্বামী! ২০২২ সালের জুন মাসে এই খবর পড়ে শিউরে উঠেছিলেন রাজ্যবাসী। রেণু খাতুন নামে সেই তরুণী সুস্থ হয়েছেন। কেটে নেওয়া হাতের জায়গায় কৃত্রিম হাত লাগানো হয়েছে। চাকরিও করছেন তিনি। তবে, নন-নার্সিং পদে। কারণ, ডান হাত হারানোয় সেই সুযোগ চিরতরে হারিয়েছেন তিনি।

    লিঙ্গভিত্তিক হিংসা সংক্রান্ত এক আলোচনাসভায় যোগ দিতে এসে রেণু জানালেন, চাকরি করা নিয়ে স্বামীর সঙ্গে গোলমাল চলছিল অনেক দিন আগে থেকেই। তবে, বচসা, এমনকি মারধরের মতো ঘটনার পরেও রেণু দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি যে, চাকরি ছাড়তে না চাওয়ার ‘অপরাধে’ তাঁকে এই শাস্তি দেওয়া হবে। ম্লান হেসে তিনি বলেন, ‘‘জোর খাটানো, মারধর, এ সব তো স্বাভাবিক বলেই দেখতে অভ্যস্ত আমরা। বাড়ি থেকেও মানিয়েই নিতে বলা হয় মেয়েদের। আসলে চরম কিছু না হলে আমরা বুঝতে পারি না যে, আগেই শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে চলে আসা উচিত ছিল। আমি মেয়ে বলে অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী হতে বাধা দেওয়া যে লিঙ্গভিত্তিক হিংসা, সেটা তখন বুঝতাম না। এখন বুঝেছি বড় ক্ষতির বিনিময়ে, যে ক্ষতি পূরণ হবে না কোনও দিনই।’’

    আজ, ১০ ডিসেম্বর, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। রাষ্ট্রপুঞ্জের তথ্য অনুযায়ী, লিঙ্গভিত্তিক হিংসা শুধু মেয়েদের উপরে অত্যাচারই নয়, এটি সারা বিশ্বে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রথম ও প্রধান কারণ। তাই এমন ঘটনা না কমালে বিশ্ব জুড়ে সুস্থায়ী উন্নয়নের (সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট) পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে লিঙ্গভিত্তিক হিংসার বিষয়টি।

    কী ভাবে বদলে যাচ্ছে লিঙ্গভিত্তিক হিংসার ধরন? কী ভাবেই বা বন্ধ করা যাবে এমন ঘটনা? আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসের আগে ‘বেঙ্গল অবস্টেট্রিক অ্যান্ড গাইনোকলজিক্যাল সোসাইটি’ ও একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আয়োজিত এক আলোচনাসভায় এই সব প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করলেন সমাজকর্মী, চিকিৎসক ও লিঙ্গভিত্তিক হিংসা থেকে বেঁচে ফেরা তরুণীরা। এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার অধিকর্তা অমৃতা দাশগুপ্ত জানান, দীর্ঘ চেষ্টার ফলে ধর্ষণ, পাচার, মারধরের মতো ঘটনা যে লিঙ্গভিত্তিক হিংসা, সেই সচেতনতা তৈরি করা গিয়েছে। তবে, এখন এমন হিংসার ধরন বদলাচ্ছে। অনেক সূক্ষ্ম উপায়ে চাপ সৃষ্টি করে মেয়েদের নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আটকে রাখার চেষ্টা হচ্ছে। পাশাপাশি রয়েছে অনলাইনে, প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে ঘটানো লিঙ্গভিত্তিক হিংসা। মর্ফ করে অশ্লীল ছবি বা ভিডিয়ো তৈরি, রিভেঞ্জ পর্নের মতো অস্ত্রের সাহায্যে হেনস্থা করা হচ্ছে মেয়েদের। অমৃতা বলেন, ‘‘বিভিন্ন জায়গায় সাইবার অপরাধ সেল তৈরি হলেও তাদের পরিকাঠামো ও আধিকারিক-কর্মীদের মানসিকতা এখনও এই ধরনের অপরাধের মোকাবিলা করার উপযুক্ত নয়।’’

    লিঙ্গভিত্তিক হিংসা কমানোর দায়িত্ব যে কেবল সমাজকর্মীদের, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির নয়, তা-ও এ দিন মনে করান বক্তারা। চিকিৎসক কিরণময়ী দেভিনেনী জানান, এই কাজে এগিয়ে আসতে হবে প্রতিটি পরিবার, প্রতিষ্ঠানকে। কারণ, লিঙ্গভিত্তিক হিংসার বীজ লুকিয়ে আছে সামাজিক কাঠামো, রীতিনীতির মধ্যেই। ছোট থেকে পরিবারে ও সমাজে বেশি গুরুত্ব পাওয়ার অভ্যাস থেকেই বহু পুরুষ হিংসার পথে হাঁটেন। ছোটবেলা থেকে যে ছেলেরা বাড়িতে লিঙ্গভিত্তিক হিংসার ঘটনা দেখতে অভ্যস্ত, বড় হয়ে একই রকম হিংসাত্মক আচরণ করার প্রবণতা তাদের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায় বলে সমীক্ষায় উঠে এসেছে। কিরণময়ী বলেন, ‘‘এক নির্যাতিতা লিঙ্গভিত্তিক হিংসার প্রত্যক্ষ শিকার, কিন্তু তাঁর সন্তানের উপরে যে পরোক্ষ প্রভাব পড়ছে, সেটিকে অনেক সময়েই গুরুত্ব দেওয়া হয় না। তাই এটা শুধু মেয়েদের বিষয় বলে সরিয়ে রাখলে হবে না, লিঙ্গভিত্তিক হিংসা কমাতে সবাইকে দায়িত্ব নিতে হবে।’’

    লিঙ্গভিত্তিক হিংসা কমাতে ছোট থেকে লিঙ্গসাম্যের পাঠ দেওয়া একান্ত জরুরি বলে জানান বক্তারা। সেই পাঠ শুরু করতে হবে বাড়ি থেকে। এগিয়ে আসতে হবে স্কুল-কলেজের মতো প্রতিষ্ঠানকেও। পাশাপাশি, মেয়েদের ক্ষমতায়নে সরকারি উদ্যোগ অপরিহার্য। আলোচনা থেকে উঠে আসে, লিঙ্গভিত্তিক হিংসার বিরুদ্ধে লড়াই শুধু মেয়েদের নয়। সরকারি ও অসরকারি ক্ষেত্র, শিক্ষক সমাজ, সুশীল সমাজ, বিভিন্ন সম্প্রদায় ও প্রতিটি পরিবার— সবাই জোট বাঁধলে তবেই মিলবে এ থেকে মুক্তির পথ।

  • Link to this news (আনন্দবাজার)