নিজস্ব প্রতিনিধি, পাথরা: তিনি মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ হয়েও ঐতিহাসিক হিন্দু মন্দির বাঁচাতে স্ত্রীর গয়না বন্ধক রাখতে দ্বিধা করেননি। এ নিয়ে দুই সম্প্রদায়ের গোঁড়াদের তিনি চক্ষুশূলও হয়েছেন। তবে তাঁর কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর চেষ্টার ফলেই পর্যটন মানচিত্রে জায়গা পেয়েছে পাথরা। কিন্তু মন্দির সংলগ্ন জমি অধিগ্রহণের টাকা পাননি চাষিরা। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি ক্ষোভে, দুঃখে তাই মন্দিরে যাওয়াই বন্ধ করে দিলেন মেদিনীপুর সদর ব্লকের পাথরা মন্দিরের প্রাণপুরুষ ইয়াসিন পাঠান। সেজন্য মন খারাপ পাথরাবাসীর। স্থানীয় বাসিন্দাদের কথায়, পাথরা মন্দির সংস্কারের জন্য কৃষকদের থেকে প্রায় ২৫ বিঘা জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। ইয়াসিনবাবুর কথায়, সেই জমি দিয়েছিলেন স্থানীয় চাষিরা। কিন্তু দুই দশক পরেও তাঁরা পাননি প্রাপ্য টাকা। এ নিয়ে ইয়াসিনবাবু একাধিকবার মোদি সরকারকে জানালেও সদুত্তর মেলেনি বলেই জানা গিয়েছে।
এদিন নিজের বাড়ির বারান্দায় বসেছিলেন ইয়াসিন। আক্ষেপের সুরে তিনি বলেন, আমাকে বিশ্বাস করেই জমি দিয়েছিলেন চাষিরা। কিন্তু বহু বছর আগে জমি অধিগ্রহণ হলেও টাকা আর পেলেন না জমিদাতারা। তাঁরা আমাকে ভুল বুঝবেন। তাই মন্দিরে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। হিন্দুদের প্রাচীন এই মন্দির রক্ষা করতে কেন্দ্রীয় সরকারের তাগিদের অভাব আছে। বহুবার রাজ্য সরকার চিঠি দিয়েছে। কিন্তু কোনও সদুত্তর মিলছে না। জমি অধিগ্রহণের টাকা আদৌ মিলবে কিনা, তা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে। বহু চেষ্টার পরেও মন্দিরটি বাঁচবে কি না, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।
প্রসঙ্গত, মেদিনীপুর শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে কংসাবতী পারেই হাতিহল্কা গ্রামে বাড়ি ইয়াসিনের। তাঁর বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে পাথরা গ্রাম। সেই গ্রামের ৩৪টি জীর্ণ মন্দির-সৌধ রক্ষার তাগিদ ছোট বয়স থেকেই তাঁকে পেয়ে বসেছিল। অল্প বয়সেই ঐতিহাসিক মন্দির নিয়ে গবেষণা শুরু করেন তিনি। এনিয়ে নানা সমস্যায় তাঁকে পড়তে হয়েছিল। পরে তারই স্বীকৃতিতে ১৯৯৪ সালে তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি শঙ্করদয়াল শর্মা ‘কবীর সম্মান’-এ বরণ করেছিলেন তাঁকে। তবে তাঁর লড়াই থামাননি। তাঁর উদ্যোগেই তৈরি হয়েছিল পাথরা আর্কিওলজিকাল প্রিজার্ভেশন কমিটি। মন্দির সংস্কারের জন্য লাগাতার চেষ্টার পর, ২০০৩ সাল নাগাদ কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে জমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দ্রুত জমি অধিগ্রহণও করা হয়। কিন্তু চাষিরা তাঁদের প্রাপ্য পাননি। পাশাপাশি, ৩৪টির মধ্যে মাত্র ১৯টি মন্দির সংস্কার হয়েছে। বাকি মন্দির জীর্ণ অবস্থায় পড়ে থাকায় ক্ষুব্ধ স্থানীয় বাসিন্দারা। স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, মন্দিরের কোনও উন্নয়ন হয়নি। নিরাপত্তার জন্য কয়েকজনকে রাখা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হয়নি। জমির টাকা পেলে উপকৃত হবেন চাষিরা। প্রথম দিকে প্রায় ৩০ জন চাষির থেকে জমি নেওয়া হয়েছিল। তবে জমি অধিগ্রহণ বহুবছর হওয়ায় শরিকের সংখ্যা বেড়েছে। একদিকে চাষও হল না, অপরদিকে টাকাও পেলেন না চাষিরা। ইয়াসিনবাবু অসুস্থ অবস্থায়ও মন্দিরে আসতেন। কিন্তু অনেকদিন ধরেই ওঁকে আর দেখা যায় না। জমি দিয়েছেন ওই এলাকার চাষি প্রভাস ভট্টাচার্যও। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় সরকার জমির টাকা দেবে কিনা বুঝতে পারছি না। মন্দিরের উন্নয়নের জন্যও সেভাবে কিছু করা হয়নি। ইয়াসিন পাথরা আসাই বন্ধ করে দিয়েছেন। যা খুবই বেদনার। ওঁকে কেউ ভুল বুঝছেন না। উনি যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন।