• দেওয়ালে নকশা ‘উধাও’, বিতর্ক শুরু আর্ট কলেজে
    আনন্দবাজার | ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪
  • আর্ট কলেজের ভবনে ঢুকেই একতলা থেকে তেতলা পর্যন্ত সিঁড়ির উল্টো দিকের দেওয়ালে চোখে পড়ত সেই নকশা। শোনা যায়, উনিশ শতকের শেষে ইবি হ‍্যাভেল অধ‍্যক্ষ থাকাকালীন জয়পুরি দেওয়াল-চিত্রের আদলে তা আঁকেন রাজস্থানের শিল্পীরাই। হ‍্যাভেলের ডাকে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তখন চারুকলা চর্চার শিক্ষাঙ্গনটিতে যাতায়াত শুরু হয়েছে। জয়পুরি ম‍্যুরালের নকশায় দেওয়াল ভরার নেপথ‍্যে তাঁরও ভূমিকা ছিল বলে শোনা যায়। অথচ, পূর্ত দফতরকে দিয়ে আর্ট কলেজ রং করানোর সময়ে সেই প্রাচীন দেওয়াল-চিত্রই মুছে ফেলার অভিযোগ উঠেছে।

    কলকাতা গভর্নমেন্ট কলেজ অব আর্ট অ্যান্ড ক্রাফ্টের বিশিষ্ট প্রাক্তনীদের একাংশ, হিরণ মিত্র, মৃত‍্যুঞ্জয় চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ সমাজমাধ‍্যমে এই ‘ধ্বংসাত্মক কাণ্ড’ নিয়ে সরব। তবে, অধ‍্যক্ষ ছত্রপতি দত্তের দাবি, ৫০ বছর বাদে আর্ট কলেজ রং করার কাজের সময়ে যা মোছা হয়েছে, তা শতাধিক বছরের পুরনো নকশা নয়। ২০০৭ সালে ন‍্যাকের পরিদর্শনের সময়ে কলেজের সাজসজ্জা। সমাজমাধ‍্যমে তাঁর দাবি, “প্রবীণ শিল্পীদের স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা করছে। যা মোছা হয়েছে, তা ম‍্যুরাল নয়। দেওয়ালের একাংশে পুরনো ম‍্যুরালের অংশ এখনও টিকে। তা সংরক্ষণে পদক্ষেপও করা হয়েছে। এ ছাড়া, কলেজের গ্রন্থাগারে ও অবন গ‍্যালারিতেও কলেজের গর্বের সম্পদ কিছু পুরনো ম‍্যুরাল এখনও রয়েছে।”

    তবে, কলেজের প্রাক্তনী শিল্পীদের একাংশের অভিযোগ, একার সিদ্ধান্তে অধ‍্যক্ষ কোনও ম‍্যুরাল বা শিল্প-স্মারক নষ্ট করতে পারেন না। এ কালে সংরক্ষণের নানা পদ্ধতি রয়েছে। চেষ্টা করলেই তা বাঁচানো যেতে পারত। প্রবীণ চিত্রশিল্পী গণেশ হালুই ১৯৫১-’৫৬ সালের আর্ট কলেজের ছাত্র। ১৯৯২ পর্যন্ত তিনি সেখানে শিক্ষকতাও করেন। জয়পুরি ম‍্যুরাল মোছার অভিযোগের পরে তা চোখে না দেখলেও গণেশ বলছেন, “পুরনো জয়পুরি নকশার চিত্রকলার আগেও মেরামতি হয়েছে। জয়পুর থেকে শিল্পীরা এসে তা করে যান। কিন্তু ২০০৭ বা অন‍্য সময়ে কোনও নতুন নকশা তৈরি হয় বলে মনে পড়ছে না।”

    কলেজের ছাত্রমহলের একাংশ বলছে, পুজোর ছুটির পরে ‘অপকীর্তি’টি ঘটেছে বলে দেখা যায়। এখনও একতলার দেওয়ালের নীচে কাচে ঢাকা পুরনো ম‍্যুরাল রয়েছে। দেওয়াল-চিত্রের বড় অংশ মুছে ফেলায় তাঁরাও ব‍্যথিত। ছত্রপতির যুক্তি, “ওই দেওয়ালে নোনা ধরে ঝুরঝুরে হয়ে গিয়েছিল। নকশাও খসে পড়ছিল। আমাদের মনে হয়, বিপুল খরচ করে ওই সব ছবি রক্ষার যুক্তি নেই। ঐতিহ্যের ক্ষতির নামে প্রবীণ শিল্পীরা অকারণ দোষারোপ করছেন।”

    পুরনো চিত্রকলা রক্ষা করতে না পারাটা ক্ষতি বলে মানলেও শিল্প ইতিহাসবিদ প্রণবরঞ্জন রায়ের কথায়, “জয়পুরি চিত্রকলায় প্রবীণ শিল্পীরা অনেকেই মুগ্ধ ছিলেন। নকশা আঁকা শেখাতে কলেজে জয়পুরি দেওয়াল-চিত্রের সাহায‍্যও নিতেন ওঁরা। শান্তিনিকেতনের পুরনো গ্রন্থাগারের বারান্দাতেও জয়পুরি ম‍্যুরাল রয়েছে। তারও রং চটেছে। কিন্তু জয়পুরি নকশা মোছা হলেও তা পুনর্নির্মাণ করা সম্ভব। রং চটা বা দেওয়ালে ফিকে হওয়া নকশা পুনরুদ্ধার অনেক সময়ে খরচসাপেক্ষ হয়। সবটা কলেজ কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে ছিল কিনা, জানি না।” তবে, আর্ট কলেজে সার্বিক ভাবে ঐতিহ‍্যের অনাদরের নানা অভিযোগ গুরুতর বলে মনে করেন প্রণবরঞ্জন। তাঁর দাবি, আগে কৃতী ছাত্রদের কলেজে পড়ার সময়কার কাজ সংরক্ষণ করা হলেও এখন আর হয় না। গণেশ পাইনের মতো শিল্পীর কাজও আর্ট কলেজ থেকে হারিয়ে গিয়েছে বলে ব‍্যথিত প্রণবরঞ্জন।

  • Link to this news (আনন্দবাজার)