নাতির হাত ধরে কৃষ্ণগঞ্জের সাত জওয়ানের শহিদ বেদিতে আলিপুরদুয়ারের মইলি ছেত্রী
বর্তমান | ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪
পলাশ পাত্র, কৃষ্ণনগর: সরকারি ঘোষণায় জানতে পেরেছিলেন একাত্তরের যুদ্ধে শহিদ হয়েছিলেন স্বামী তেক বাহাদুর। তার পর দীর্ঘ ৫৩ বছর খুঁজে বেড়িয়েছেন স্বামীর শহিদবেদি। কোথাও পাননি। কেন্দ্রীয় সরকারও বিষয়টি নিয়ে নীরবই থেকেছে। শেষে হাল ছেড়ে একরাশ আক্ষেপ বুকে চেপে বড়িতেই বসেছিলেন বৃদ্ধা মইলি ছেত্রী।
চলতি বছর অক্টোবর মাসে দীর্ঘ প্রতিক্ষার অবসান ঘটে মইলির। রাজ্য সৈনিক বোর্ডের কর্তারা ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে ৭ জওয়ানের শহীদবেদির সন্ধান পায়। তাতে খানিক হাসি ফোটে মইলির মুখে। সোমবার ছিল বিজয় দিবস। এদিন তাঁকে সেই শহিদবেদিতে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয় প্রশাসনের তরফে। সেই মতো কৃষ্ণগঞ্জের খালবোয়ালিয়ার সত্যনগরে এসে আনন্দাশ্রুতে স্বামীর শহিদবেদিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন মইলি ছেত্রী। সেখানে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘আমি গর্বিত। আমি এখানে আসতে পেরে খুব ভালো লাগছে।’ তবে, কেন্দ্রের কোনও সরকার কোনওদিন তাঁর স্বামীর শহিদবেদির সন্ধান দিতে পারেনি বলে ক্ষোভ উগরে দেন মইলি।
এদিন রাজ্য সৈনিক বোর্ড ও কৃষ্ণগঞ্জ এক্স সার্ভিসম্যান অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে বিজয় দিবস পালন করা হয়। সেই মতো শহিদ ৭ জওয়ানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী উজ্জ্বল বিশ্বাস, সদর মহকুমাশাসক শারদ্বতী চৌধুরী, বিডিও সৌগত কুমার সাহা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি কাকলি দাস সহ একাধিক ব্যক্তিবর্গ। এছাড়া রাজ্য সৈনিক বোর্ডের কর্তা পার্থ বারিক, রঞ্জন মুখোপাধ্যায়, সুকুমার ঘোষরা উপস্থিত ছিলেন।
গত অক্টোবর মাসে কৃষ্ণগঞ্জের সত্যনগরে চরম অব্যবস্থায় পড়ে থাকা ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে ৭ জওয়ানের শহিদ বেদি দেখতে রাজ্য সৈনিক বোর্ডের একটি টিম আসে। সবকিছু সরেজমিনে দেখে তারা ‘ন্যাশনাল মেমোরিয়াল’ গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। জানা গিয়েছে, ১৯৭১ সালে ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সেনারা এই কৃষ্ণগঞ্জের ক্যাম্পের কাছে চলে এসেছিল। জওয়ানরা প্রাণ দিয়ে দেশকে সেই সময় রক্ষা করেছিলেন। পাকিস্তান সেনাদের হাতে ভারতীয় ৭ জওয়ান শহিদ হন। তাঁদের ওই সময় কৃষ্ণগঞ্জের মাথাভাঙা নদীর তীরে সৎকার করা হয়। শহিদ এই সাতজনের নাম বলবন্ত সিং, ভৈরব দত্ত, মোহন সিংহ, মূর্তি সিংহ, মহেশ্বর সিংহ, দুর্গা সিংহ ও তেক বাহাদুর। এর মধ্যে মোহন সিং মরণোত্তর পুরস্কার পেয়েছেন। শহিদ হওয়া এই ৭ ভারতীয় সেনার অস্থি তৎকালীন সময়ে থাকা কৃষ্ণগঞ্জের আর্মি ক্যাম্প এলাকায় রেখে শহিদ বেদি করা হয়। একসঙ্গে সাতজনের শহিদ বেদি রাজ্যের কোথাও হয়নি।
১৯৭১ সালের ২৬ নভেম্বরে এই ঘটনার পর ৫৩ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। গোটা এলাকায় ভরে ওঠে ঝোপ জঙ্গলে। সেটি কৃষ্ণগঞ্জের খালবোয়ালিয়া সত্যনগর এলাকায় মল্লিকদের বাগান। সেখানে শুরু হয় অন্ধাকার জগতের মানুষের আনাগোনাও। অনাদরে পড়ে থাকে শহিদদের এই সমাধিস্থলটি। ২০২২ সালের ২৪ এপ্রিল কৃষ্ণগঞ্জে গড়ে ওঠে এক্স সার্ভিসম্যান অ্যাসোসিয়েশন। তারা এই শহিদ বেদির সন্ধান পেয়ে জেলা ও রাজ্য সৈনিক বোর্ডের কর্তাদের জানান। এরপর থেকেই এই এলাকাটি নিয়ে আলাদা করে আলোচনা শুরু হয়। সেই মতো গত বছর এখানে বিজয় দিবস পালন করা হয়।
এদিন বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য আলিপুরদুয়ারের বীরপাড়া থেকে শহিদ তেক বাহাদুরের স্ত্রী মইলি ছেত্রী আসেন। তিনি গতকাল সন্ধ্যায় তাঁর নাতি ঋষভ ছেত্রীকে নিয়ে কৃষ্ণগঞ্জ আসেন। সত্যনগরে রবিবার সন্ধ্যায় স্বামীর শহিদবেদি দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। সোমবার অবশ্য নিজেকে তিনি অনেকটা সামলে নেন। মইলি ছেত্রী বলছলেন, ‘আমি অনেক খুঁজেছি। অনেক কষ্ট হয়েছে। হচ্ছেও। ৫৩ বছর পর পেলাম। আমি অবশ্যই এখানে প্রতি বছর আসব।’
স্বামীর শহিদবেদি খোঁজার সফর শেষ করে নয়া সফর শুরু করলেন মইলি। নিজস্ব চিত্র