সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়, কোচবিহার (বাণেশ্বর): ‘আমার সাত রাজার ধন মানিক হারিয়ে গেল...’ বুক চাপড়ে এ কথাই বার বার বলছিলেন সুনীতিবালা রায়। বাড়ির সামনের একফালি জমিতে তখন এলাকার মহিলারা তাঁকে ঘিরে রয়েছেন। সকলেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। বাড়ির উল্টো দিকের মাঠে ভিড় থিক থিক করছে। পাড়ার ছেলে সঞ্জিতকে তাঁরা ভালো বাসতেন। ছোট থেকে বড় হতে দেখেছেন। চোখের সামনেই বিয়ে হল। দু’টি ফুটফুটে সন্তানের পিতা। সেই সঞ্জিতের এমন সপরিবার মৃত্যুর ঘটনা! এই সত্য দুপুর পর্যন্তও মেনে নিতে পারছিলেন না এলাকার বাসিন্দারা। চার চারটি মৃতদেহ তখনও কোচবিহারের মহারাজা জিতেন্দ্রনারায়ণ মেডিক্যাল কলেজের মর্গে। বিকেলে প্লাস্টিকে মোড়া দেহ বাড়িতে নিয়ে আসতেই গোটা গ্রাম যেন আছড়ে পড়ে রায়বাড়ির সামনের মাঠে। বাণেশ্বর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার একটি দোকানে কথা হচ্ছিল সুনীল রায়, দোকাদার কানু পালের সঙ্গে। সঞ্জিতবাবুর বাড়ি থেকে দোকানটি প্রায় চার কিমি দূরে। তাঁরাও শোকস্তব্ধ। বললেন, সঞ্জিত ভালো ছেলে ছিল। ওঁকে চিনতাম। ওঁরা স্বামী-স্ত্রী শিক্ষক হওয়ায় সকলেই কমবেশি চিনতেন। দুপুরে সঞ্জিতবাবুর বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন ফুলেন্দ্রনাথ রায়, নরেশ রায়, গৌরাঙ্গ বর্মন। সকলেরই বয়স ৬০ ছুঁই ছুঁই। কৃষিজীবী মানুষ। তাঁরা বলছিলেন, চোখের সামনে ছেলেটি বড় হয়েছে। কিছুদিন আগেই ওঁর বাবা মারা যান। আজ এমন ঘটনা ভাবতেও পারছি না। সকালে খবর পাওয়ার পর আর কোনও কাজকর্ম করতে পারিনি। এলাকার যুবক সুমন্ত বর্মন বলেন, আমি নাটাবাড়ির কদমতলায় মেলায় গিয়েছিলাম। রাতে সেখান থেকে ফিরছিলাম। সেসময়েই দুর্ঘটনাস্থলের সামনে পৌঁছই। ওঁদের চিনতে পেরে এলাকায় খবর দিই। বাণেশ্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের কাউয়ারডারার বাসিন্দা সঞ্জিত রায়, স্ত্রী বিপাশা রায় সরকার, পাঁচ বছরের মেয়ে ইশাশ্রী রায় ও দুই বছরের ছেলে ইভান রায়ের পথ দুর্ঘটনায় রবিবার রাতে মৃত্যু হয়েছে। বিয়েবাড়ির অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পথে গাড়ি পুকুরের জলে পড়ে গেলে দুই শিশু সহ শিক্ষক দম্পতির মৃত্যু হয়। এই ঘটনায় গোটা এলাকা শোকে মহ্যমান। খবর পেয়ে সোমবার দুপুরে সঞ্জিতবাবুর বাড়িতে আসেন কোচবিহার পুরসভার চেয়ারম্যান রবীন্দ্রনাথ ঘোষ, উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ নিগমের চেয়ারম্যান পার্থপ্রতিম রায়। তাঁদের দু’জনকে একসঙ্গেই দেখা গিয়েছে মৃতার মা’কে সান্ত্বনা দিতে। কোচবিহার উত্তরের বিধায়ক তথা বিজেপির জেলা সভাপতি সুকুমার রায়, জেলার পুলিস সুপার দ্যুতিমান ভট্টাচার্য সহ আরও বহু লোক এদিন মৃত শিক্ষক সঞ্জিতবাবুর বাড়িতে আসেন। সকলেই মর্মান্তিক এমন ঘটনায় শোকস্তব্ধ। রবীন্দ্রনাথ ঘোষ বলেন, এমন ঘটনায় বলার কোনও ভাষা নেই। মর্মান্তিক এমন ঘটনা ভগবান যেন আর কারও ক্ষেত্রে না ঘটান! শোকার্ত পরিজন।-নিজস্ব চিত্র