নিজস্ব প্রতিনিধি, বারাসত: কাদাজলে ভিজলে ঠান্ডা লাগে। শুকনো, উত্তপ্ত জমিতে নামলে পা পুড়ে যায়। তবে চাষ ছাড়েন না তিনি। ধানের বীজতলার কাজ নিজে হাতে করেন। শীতের সবজি চাষ করেন। মাথায় গামছা বেঁধে লাঙল দেন। জমির মাটি সমান করেন। কোনই কাজই বস্তুত বাদ দেন না। হাবড়ার কুমড়া-কাশীপুরের বয়রাঘাটা গ্রামে থাকেন। চাষবাসের রাজত্বের পুরুষালি দুর্গে প্রতিদিনই পা রাখেন স্নাতক রুমা মণ্ডল। তিনি বিএ পাশ করেছেন। যে হাতে পেন ধরে লিখে পরীক্ষায় পাশ উত্তীর্ণ হয়েছিলেন এখন সেই হাতে কোদাল। চাষ করে মানুষের নজরও কেড়েছেন তিনি। কেবল চাকরি ও ব্যবসা করলেই সংসার স্বচ্ছল হয়-এই সামাজিক মিথ ভাঙতে চাইছেন বিএ পাশ এই ছাত্রী। তিনি বলেন, ‘আমাদের পরিবার দরিদ্র। তবে চাষ করে সংসারে সুদিন আসবে বলেই আমি বিশ্বাস করি।’
রুমার বাবা কৃষ্ণা মণ্ডল কৃষক। মা শ্যামলীদেবী কুমড়া বাজারে সব্জির দোকান চালান। চার ছেলেমেয়ের মধ্যে রুমা মেজো। তাঁদের অভাবের সংসার। পরিবারের রয়েছে মাত্র দু’কাঠা জমি। এর সঙ্গে কিছু জমি ভাগে নিয়ে চাষ করেন। সব মিলিয়ে দু’বিঘার মতো জমি। বাবার সঙ্গে চাষের কাজে হাত লাগাতেন ছোট থেকে। তবে স্বপ্ন ছিল সরকারি চাকরি। তা পেলে সংসারের অভাব ঘুচবে। কিন্তু কাঁটা হয়ে দাঁড়ায় টাকা। নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর সংসারে ২০১৭ সালের উচ্চ মাধ্যমিকে তিনি পান ৩৪০। বিএ পাশ করেন হাবড়ার চৈতন্য কলেজ থেকে। তিন বছর ধরে কোনও কোচিং ছাড়াই একাধিক চাকরির পরীক্ষাতে বসেন। কিন্তু শিকে ছেঁড়েনি। ফলে উচ্চশিক্ষিতা হয়েও বাবার জমিতেই পাকাপাকি চাষের কাজে মনযোগ দেন। ভোরে উঠে দুই বাড়িতে গৃহশিক্ষকতা করতে যান। বাড়ি ফিরে রান্না করেন। তারপর যান চাষের জমিতে। এটাই তাঁর রোজনামচা। কোদাল হাতে জমি সমান করা থেকে সার ঠিক আছে কি না দেখেন। গাছের গোড়ায় মাটি দেওয়া থেকে সবটাই নিজের হাতে সামলান। জানা গিয়েছে, রুমার বড়দির বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ছোট ভাই পড়াশোনা করছে। বোন সবে কলেজের পড়া শেষ করেছে। ওঁদের পড়াশোনার খরচও বহন করেন রুমা।
তিনি বলেন, ‘সংসার চালানো খুব কষ্টের। টাকা না থাকায় আমি অনার্স নিয়ে ভর্তি হতে পারিনি। বিএ পাস করার পর চাকরির চেষ্টা করেও লাভ হয়নি। তাই গত দু’বছর চাষে মন দিয়েছি। চাষ করে উপার্জন করি তা দিয়ে সংসার চলছে। আমি মনে করি চাষের কাজে সম্মান আছে। প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায়। পরিবারে স্বচ্ছলতা আনা সম্ভব। সেটাই আমি করে দেখাব।’ রুমার প্রতিবেশী সঞ্জীব কাঞ্জিলাল বলেন, ‘কোনও পেশাই ছোট নয়। বোন রুমা সমাজের মিথ ভাঙতে চাইছে। প্রথম প্রথম অনেকে তাঁর দিকে তাকিয়ে চোখ পাকালেও এখন সে এলাকার রোল মডেল। লোকমুখে সে পরিচিত বিএ পাস চাষি বলে।’ নিজস্ব চিত্র