কৌশিক সেন, রায়গঞ্জ
নাগাড়ে মন্ত্রোচ্চারণ করে চলেছেন পুরোহিত। বিয়ের মণ্ডপে মেনে চলা হচ্ছে সমস্ত বিধি, আচার এবং নিয়ম। কিন্তু ‘শুভদৃষ্টি’র সময়ে থমকে গেলেন পুরোহিত। পাত্র অস্বস্তিতে। পাত্রী চুপ। কয়েক সেকেন্ডের বিরতিতে নীরবতা ভাঙলেন পাত্রী নিজেই। বললেন, ‘ও ঠাকুরমশাই, দেখার জন্য চোখই কি সব নাকি! মন দিয়েও তো কত কিছু দেখা যায়!’
ব্যস, অন্তর্দৃষ্টিতেই যেন দু’জন দু’জনকে দেখে নিলেন। তারপরে হইহই করে হয়ে গেল শুভদৃষ্টি, মালাবদল, সাতপাক। রবিবার রাতে পুতুল মাহাতো ও কৃষ্ণ দাসের বিয়ের সাক্ষী থাকল উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জ।
বিয়ের কাজ সাঙ্গ করে পুরোহিত রিপন আচার্য বেশ গর্বের সঙ্গে বললেন, ‘প্রায় তিরিশ বছর ধরে কত ছেলেমেয়ের বিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু এই প্রথম এমন চারহাত এক করে দিলাম। আশীর্বাদ করি, ওরা যেন আজীবন অন্তরের দৃষ্টি দিয়ে একে অন্যকে দেখে রাখে, আগলে রাখে, ভালো রাখে।’
বলিউডের ‘কাবিল’ সিনেমাটার কথা মনে আছে?
২০১৭ সালে মুক্তি পাওয়া সেই সিনেমায় রোহন (হৃতিক রোশন) ও সুপ্রিয়া (ইয়ামি গৌতম) দু’জনেই ছিলেন দৃষ্টিহীন। রোহন ও সুপ্রিয়া প্রেম পেরিয়ে বাঁধা পড়েছিলেন পরিণয়ে। সদ্য বিবাহিত পুতুল ও কৃষ্ণ কেউই ‘কাবিল’ দেখেননি। কিন্তু দু’জনেই কবুল করেছেন, ‘মনে মনে বাঁধা পড়ে গিয়েছিলাম আগেই। বিয়েটা ছিল স্রেফ সময়ের অপেক্ষা।’
রায়গঞ্জের পশ্চিম সাহাপল্লির চিলতে বাড়িতে দীপক মাহাতোর স্ত্রী, পুত্র, কন্যাকে নিয়ে অভাবের সংসার। এ দিকে, বড় মেয়ে পুতুল জন্ম থেকেই দৃষ্টিহীন। তবে পুতুল থেমে থাকেননি কখনও। নিজের উদ্যোগেই লেখাপড়াটা চালিয়ে যাচ্ছেন। এখন তিনি রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। পুতুলের কথায়, ‘সুমিতা রায় নামে আমার এক বেস্টফ্রেন্ড আছে। সে-ও আমার মতোই। দৃষ্টিহীন। গত এপ্রিলে হুগলির তারকেশ্বরে তার বিয়ে হয়। সুমিতার মাধ্যমেই আলাপ হয় কৃষ্ণের সঙ্গে। নিয়মিত ফোনে কথা হতো। অবশেষে বিয়েটাও হয়ে গেল।’
পুতুলের স্বামী কৃষ্ণ দাস থাকেন হুগলির পান্ডুয়ায়। তিনিও জন্ম থেকেই দৃষ্টিহীন। একটা সময়ে বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে তিনি দৃষ্টিহীন বাচ্চাদের পড়াতেন। সেটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে এখন হাওড়া-ব্যান্ডেল ট্রেন রুটে ফেরি করেন। কৃষ্ণ বলেন, ‘টেলিফোনেই আলাপ হয়েছিল পুতুলের সঙ্গে। আর এখন থেকে তো সারা জীবনেরই সঙ্গী হয়ে গেল।’
পাড়ার মেয়ের বিয়ে হচ্ছে শুনে বেজায় খুশি এলাকার বাসিন্দারা। কিন্তু পুতুলের বাবা দীপক জানান, তাঁর আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। তিনি বিয়েতে তেমন কিছু করতে পারবেন না। ঠিক সেই সময়ে এগিয়ে আসেন পাড়ার লোকজনই। তাঁরাই উদ্যোগী হয়ে টাকাপয়সার ব্যবস্থা করে বেশ ধুমধাম করেই পুতুল-কৃষ্ণের বিয়ে দিয়েছেন। দীপক বলেন, ‘এলাকার সকলেই আমার মেয়ের বিয়েতে যে ভাবে এগিয়ে এসেছেন, সেই ঋণ আমি কখনও ভুলব না।’ এলাকার বাসিন্দা ত্রিদেবকুমার রায় বলেন, ‘পুতুল আমাদের পাড়ার মেয়ে। ওর বিয়েতে কোনও ফাঁক রাখিনি।’
শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশে রওনা দেওয়ার সময়ে পুতুল বলেন, ‘কৃষ্ণ কথা দিয়েছে, ও আমাকে লেখাপড়াটা চালিয়ে যেতে দেবে। কী গো, কথা রাখবে তো?’ কৃষ্ণ জবাব দেন না। শুধু পুতুলের ডান হাতটা শক্ত করে চেপে ধরেন।