ধুঁকছে পশ্চিমবঙ্গের বিড়ি শিল্প, বিপন্ন লাখ লাখ শ্রমিকের জীবন-জীবিকা...
আজকাল | ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪
আজকাল ওয়েবডেস্ক: পশ্চিমবঙ্গের বিড়ি শিল্প, গত কয়েক দশক ধরে মহিলাদের কর্মসংস্থান ও আর্থিক স্বনির্ভরতাকে নিশ্চিত করেছে। কিন্তু এই শিল্পই আজ চরম অনিশ্চয়তার সম্মুখীন। জীবিকার জন্য এই শিল্পের ওপর নির্ভর করেন বাংলার প্রায় ১৮ লক্ষেরও বেশি মানুষ, যা সারা ভারতে সর্বাধিক। বিড়ি বাঁধা এই শিল্পের মূল কাজ। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল মানুষের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ বিড়ি বেঁধে উপার্জন করেন। এই শিল্পের সঙ্কট এক বিরাট সংখ্যক শ্রমজীবী মানুষকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিতে পারে বলে আশঙ্কা। মহিলারাই হলেন পশ্চিমবঙ্গের বিড়ি শিল্পের মেরুদণ্ড। কারণ এই শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিকদের ৯৮.৩৫ শতাংশই হলেন মহিলা। আসলে বিড়ি বাঁধার কাজটা বাড়িতে বসেই করা যায়। ফলে, তাঁরা সংসারে কাজ সামলেও উপার্জন করতে পারেন। কাজের এই সুবিধের জন্য এই শিল্প তাঁদের কাছে আকর্ষণীয়। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাধার কারণে মহিলাদের কাজের সুযোগ সীমিত। ফলে বাড়িতে বসে উপার্জনের জন্য বিড়ি শিল্প ছিল বড় অবলম্বন। সম্প্রতি এক আলোচনা সভায়, মুর্শিদাবাদের এক জন বিড়ি শ্রমিক বলেন. "বিড়ি বাঁধাই আমাদের জীবন। জলের মতোই প্রয়োজনীয় এই কাজ। বিড়ি বাঁধার কাজ না থাকলে আমরা গভীর সঙ্কটের মধ্যে পড়ব। ওটাই আমাদের বেঁচে থাকার সম্বল।" ওই বিড়ি শ্রমিকের কথায় উঠে এসেছে, পশ্চিমবাংলায় মহিলাদের আর্থিক সুরক্ষা ও ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বিড়ি শিল্পের গুরুত্ব। কিন্তু বিড়ি শ্রমিকদের কম বেতন ও সামাজিক সুরক্ষার অভাব চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক সমীক্ষা থেকে জানা গিয়েছে যে, বিড়ি বাঁধেন যে শ্রমিকরা, পশ্চিমবঙ্গে তাঁদের মাসিক গড় আয় মাত্র ২,১০০ টাকা থেকে ৩,০০০ টাকা। যা নুন্যতম প্রয়োজনগুলি মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়। তা ছাড়া, এক বড় সংখ্যক বিড়ি শ্রমিকের কোনও সরকারি স্বীকৃতি নেই। ফলে, তাঁরা কল্যাণমূলক কর্মসূচির আওতার বাইরেই থেকে যান এবং নানা শোষণ ও আর্থিক অনিশ্চয়তার স্বীকার হন। তাছাড়া, বিড়ি শিল্পের ওপর জিএসটির মরাত্মক চাপ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। বিড়ির ওপর ২৮ শতাংশ জিএসটি বসানোর ফলে উৎপাদন খরচ বেড়েছে, কমেছে শ্রমিকদের মজুরি। এই পরিস্থিতিকে সামাল দিতে সরকারি হস্তক্ষেপের দাবি উঠছে। ছোট বিড়ি প্রস্তুতকারকদের স্বার্থে জিএসটির হার কমানো ও সহায়ক পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি উঠেছে। তার ফলে ছোট বিড়ি কারখানার মালিকরা তাঁদের শ্রমিকদের যথাযথ মজুরি দিতে পারবেন বলে মনে করা হচ্ছে। এক দিকে এই শিল্প যেমন কয়েক লক্ষ শ্রমিকের ক্ষেত্রে এক জীবনদায়ী ভূমিকা পালন করছে, তেমনই অন্য দিকে তাঁদের কাজের অবস্থার উন্নতি ও সামাজিক সুরক্ষা বাড়ানোর চাহিদাও থাকছে। এই টানাপোড়েনের মধ্যে ঝুলে রয়েছে বিড়ি শিল্প। ভবিষ্যতে বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। পশ্চিমবঙ্গে বিড়ি শিল্পের দীর্ঘমেয়াদি সফলতা নির্ভর করছে, শ্রমিক কল্যান সংক্রান্ত প্রশ্নগুলির সমাধান ও আর্থিক সুস্থিতির ওপর। বিড়ি শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারের আরও ন্যায্য ও সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য কয়েকটি পদক্ষেপ করা জরুরি। যেমন, উপযুক্ত মজুরি নিশ্চিত করা, সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলির সুবিধে তাঁদের কাছে পৌঁছে দেওয়া ও শিল্পের আধুনিকীকরণের উপায়গুলি খুঁজে দেখা। অন্তত তেমনটাই মনে করছেন বিশেজ্ঞরা। পুনে শহরের দেশাই ব্রাদার্স লিমিটেড একটি প্রথম সারির বিড়ি প্রস্তুতকারী সংস্থা। বিভিন্ন জায়গায় কাজ করে সংস্থাটি। ওই সংস্থার মালিক বিমল দেশাই বলেন, "খুচরো ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত ভয় ধরাচ্ছে। এর ফলে বিড়ি বিক্রি করা থেকে দূরে সরে যাবেন তাঁরা। এই সিদ্ধান্ত বহু মহিলা ও তাঁদের পরিবারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে যে, বিড়ি শ্রমিকরা তাঁদের প্রাপ্য সুবিধেগুলি পাবেন এবং সরকার তাঁদের সবরকম ভাবে সাহায্য করবেন। কিন্তু সেই সুবিধেগুলি এখনও কেউ চোখে দেখেননি। প্রতিশ্রুতিগুলিও এখনও পালন করেননি সরকার।" জীবিকার জন্য বিড়ি শিল্পের ওপর নির্ভরশীল লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন সুরক্ষিত করা ও তাঁদের ক্ষমতায়নের স্বার্থে প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলি যে জরুরি ভিত্তিতে করতে হবে, বিমল দেশাইয়ের মন্তব্য সেদিকেই ইঙ্গিত করে।