৯ মাস বয়সে হারিয়েছিলেন দৃষ্টিশক্তি, অধ্যাপক হওয়ার লক্ষ্যে কঠিন পথে লড়াই অনুপের ...
আজকাল | ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪
মিল্টন সেন, হুগলি: অদম্য ইচ্ছে শক্তির কাছে হার মানতে বাধ্য শারীরিক প্রতিবন্ধকতা। সেকথাই প্রমান করেছেন ভদ্রেশ্বরের অনুপ সিং। দৃষ্টি শক্তি হারিয়েও থেমে থাকেননি। প্রবেশিকা পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান অধিকার করেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্কলারশিপ নিয়ে স্নাতকোত্তর। বর্তমানে লক্ষ্য জুনিয়ার রিসার্চ ফেলোশিপ। প্রস্তুতি চলছে জোর কদমে।
মাত্র ৯ মাস বয়সে ডায়রিয়ার প্রকোপে নষ্ট হয় অনুপের দৃষ্টি শক্তি। একাধিক চিকিৎসকের চেষ্টা বিফলে যায়। প্রথমে নষ্ট হয় বাঁ চোখ, তার কিছুদিন পরেই নষ্ট হয়ে যায় ডান চোখ। পরিবারের অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও আর দৃষ্টিশক্তি ফেরানো সম্ভব হয়নি।
কিন্তু দৃষ্টিশক্তিহীনতা কোনও ভাবেই দমিয়ে রাখতে পারেনি তাঁর ইচ্ছে শক্তিকে। লক্ষ্য স্থির রেখে একের পর এক প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে এগিয়ে চলেছেন হুগলির ভদ্রেশ্বরের গৌরহাটির বছর ২৮-এর অনুপ সিং। আজও লক্ষ্যে অবিচল, তাঁর টানা অধ্যয়নে এসেছে একের পর এক সাফল্য। বর্তমানে চলছে তাঁর জুনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপের প্রস্তুতি। পরীক্ষা শুরু হবে ১জানুয়ারি, চলবে ১৯ জানুয়ারি পর্যন্ত। উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা গীতা সিং-এর ছেলে অনুপ। গত ২০০১ সালে স্বামী ছেড়ে চলে যাওয়ার পর, চার সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে তিনি চলে আসেন হুগলিতে। বর্তমানে গৌরহাটিতে একচিলতে টালির বাড়িতে দুই সন্তানের সঙ্গে থাকেন গীতা দেবী। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট ছেলে কম্পিউটার নিয়ে পড়াশোনা করছে। বড় ছেলে অনুপ ছোট থেকেই দৃষ্টিহীন। সন্তানদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে তাঁকে অন্যের বাড়িতে কাজ করেছেন। হুগলিতে আসার পর শ্রীরামপুর সেবা কেন্দ্র ও আই ব্যাঙ্কের কর্মী শ্রীদাম সাহার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। তিনি আবারও অনুপের দৃষ্টি ফেরানোর চেষ্টা করেন। অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ওই সংস্থার চিকিৎসক জানিয়ে দেন অনুপের চোখের দৃষ্টি ফেরানো কার্যত অসম্ভব। তার পরেই শ্রীদাম সাহার উদ্যোগে অনুপকে উত্তরপাড়া ব্লাইন্ড স্কুলে ভর্তি করা হয়।
লক্ষ্য স্থির করে শুরু হয় অনুপের লড়াই। সেখানে ব্রেল পদ্ধতি অবলম্বন করে অষ্টম শ্রেণি পাস করার পর ২০১৪ সালে অনুপ ক্যালকাটা ব্লাইন্ড স্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। ২০১৯ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান অধিকার করেন। স্নাতকোত্তরে স্কলারশিপ পান। বিএড-এর জন্য রবীন্দ্রভারতীতে আবেদন করেন, সঙ্গে চলে তাঁর জুনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপের প্রস্তুতি। পড়াশোনার পাশাপাশি অনুপ কম্পিউটার শিক্ষা এবং ক্যাসিও বাজাতে যথেষ্ট পারদর্শী। এদিন অনুপ জানিয়েছেন, চোখের চিকিৎসা করাতে একবার তিনি হায়দরাবাদে গিয়ে চোখের অস্ত্রোপচার করিয়ে ছিলেন। সেখানেও চিকিৎসক জানিয়ে দেন চোখের নার্ভ শুকিয়ে যাওয়ার জন্য, আর দৃষ্টি ফেরানো সম্ভব হবে না। তাই লক্ষ্য স্থির রেখে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে শুরু করেন। পলিটিক্যাল সাইন্স নিয়ে মাস্টার্স করেন। ২০২৪ সালের নেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। বর্তমানে তিনি ভারতের বিদেশ নীতি নিয়ে পড়াশোনা করছেন। জিআরএফ পেলে, স্কলারশিপ পেতেও সুবিধা হবে। পড়াশোনার জন্য তাঁকে রেকর্ডিং মেশিন কিনতে হয়েছে। ২৩৮ পাতার বই ৩২ জিবি পেনড্রাইভে লোড করা আছে। এছাড়া পড়াশোনার জন্য অ্যাপ ব্যবহার করেন। মাঝেমধ্যে ইউটিউব থেকেও পড়াশোনা করেন। মা গীতা তাঁকে অনেক সাহায্য করেন। শ্রীদাম সাহা অনেক সাহায্য করেছেন। বন্ধুদের থেকেও সাহায্য নিয়েছেন। লক্ষ্য অধ্যাপক হওয়া। এই প্রসঙ্গে গীতা দেবী বলেছেন, রান্নার কাজ করে ছেলেকে পড়াশোনা শেখাচ্ছেন। ইতিমধ্যেই পড়ানোর জন্য তিনি ৮০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। অনেক চেষ্টা করেছেন, কোনও ভাবেই অনুপের দৃষ্টি ফেরানো সম্ভব হয়নি। ছবি পার্থ রাহা।