• বললেন, ‘ইয়ে হাত মুঝে দে দে ঠাকুর’, ওস্তাদ জাকির হুসেনের স্মৃতিচারণায় পণ্ডিত কুমার বসু
    এই সময় | ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪
  • পণ্ডিত কুমার বসু

    ১৯৭৮–এ জার্মানির স্টুটগার্টে প্রথম আলাপ। উনি গিয়েছিলেন হরিজি (হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া) আর শিবজির (শিবকুমার শর্মা) সঙ্গে বাজাতে। আমি গিয়েছিলাম উস্তাদ ইমরাত খানের সঙ্গে সঙ্গত করতে। ‘ওহ, আপনি কলকাতা থেকে?’ — প্রথম আলাপ সীমাবদ্ধ ছিল অল্প কথায়। অদৃষ্ট হেসেছিল। কারণ, সে–ই জানত আগামীতে ওই আলাপ গভীর বন্ধুত্বে পরিণত হবে! ৪৬ বছরের পুরোনো সেই বন্ধুত্বকে ভীষণ একা করে জাকির ভাই চলে গেলেন। এই ধাক্কা আমার কাছে বড় নির্মম।

    তবলাকে গত কয়েক দশকে যাঁরা অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, যাঁরা তবলার জগতে আলাদা দিগন্তের খোঁজ দিয়েছিলেন — জাকির ভাই তাঁদের অন্যতম। বিভিন্ন সময়ে মানুষের মুখে মুখে একটা করে জুটি তৈরি হয়ে যায়। উত্তম-সুচিত্রা, সচিন-সৌরভের মতো একটা সময়ে জাকির ভাই আর আমার নামও সঙ্গীতরসিকদের মুখে একসঙ্গে উচ্চারিত হতো — জাকির-কুমার বলে। কিন্তু, সত্যি কথা বলতে কি আমি কোনওদিন ওঁর সমপর্যায়ের ছিলাম না। উনি যে আমার থেকে অনেক এগিয়ে ছিলেন, এ কথা অকপটে স্বীকার করতে আমার কোনও বাধা নেই।

    তবে আমাদের মধ্যে অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ একটা প্রতিযোগিতাও ছিল। যার জন্য দু’জনের বাজনাই যেন আরও বেশি করে খুলে যেত। ওঁর সঙ্গে বাজালে মনটা এমন একটা শান্তিতে ভরে যেত যেটা বলে বোঝাতে পারব না। স্টুটগার্টে ওই অনুষ্ঠানে আলাপের পরে দেশে-বিদেশে বহুবার একসঙ্গে বাজিয়েছি। লন্ডনে, রয়্যাল অ্যালবার্ট হলে পণ্ডিত রবিশঙ্করজি, জাকির ভাই আর আমি — একসঙ্গে বাজিয়েছিলাম। আসলে ওঁর মধ্যে অদ্ভুত একটা আপন করে নেওয়া, দিলখোলা ব্যাপার ছিল। পরিচয় একটু গাঢ় হওয়ার পরেই উনি আমার ‘জাকির ভাই’ আর আমি ওঁর ‘কুমার ভাই’ হয়ে গিয়েছিলাম। সেই সম্পর্কটা শেষ দিন পর্যন্ত ছিল। ঔরঙ্গাবাদে একটা অনুষ্ঠানে আমার বাজনা শুনেছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে আমার বাঁয়ার কাজ খুব প্রশংসিত হয়েছিল। জাকির ভাই এসে হাসতে হাসতে আমাকে বলেছিলেন, ‘ইয়ে হাত মুঝে দে দে ঠাকুর!’

    রসিক, হাজির-জবাব, ইন্টালিজেন্ট এবং সর্বোপরি ভালো মানুষ — রক্ত-মাংসের জাকির ভাই সম্পর্কে বলতে গেলে কোনটা যে আগে রাখব সেটা বাছাই মুশকিল। তবে অজাতশত্রু এমন মানুষটাকেও রেগে যেতে দেখেছি। রাগলে চিৎকার-চেঁচামেচি নয়, কথা বলা বন্ধ করে দিতেন। একটা-দু’টো মাত্র কথায় যা বোঝানোর বুঝিয়ে দিতেন। তারপর ওই জায়গা ছেড়ে কিছুটা দূরে কোথাও চলে যেতেন। সম্ভবত ওঁর রাগ যাতে নিয়ন্ত্রণ না–হারায় তার জন্যই এমন করতেন। ওঁর চরিত্রের সবচেয়ে খারাপ দিক ছিল স্বাস্থ্য সম্পর্কে উদাসীনতা। খেতে, বিশেষ করে মশলাদার খাবার খেতে ভীষণ ভালোবাসতেন। কাউকে ‘না’ বলতে পারতেন না। অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ এলেই যেতেন। হার্টে চারটে স্টেন্ট বসেছিল। ডাক্তার বলেছিলেন সার্জারি করিয়ে নিতে। কিন্তু স্টেন্ট বসানোর পরে শরীর অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠতেই ফের অনিয়ম শুরু করেন।

    আমার সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল তিন সপ্তাহ আগে মেসেজের মাধ্যমে। ইউএসএ-তে আমার আত্মীয়র সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সেই কথা জানিয়ে বলেছিলেন, ‘আপনি থাকলে বেশি ভালো হতো।’ বলেছিলাম, শরীরের যত্ন নিতে। এই বছরের বাকি সব ট্যুর বাতিল করেছেন বলে জানিয়েছিলেন। রিপ্লাই করেছিলাম, ‘গুড বয়।’ আমেরিকান ডাক্তারদের চেয়ে ওঁর ভারতীয় ডাক্তারদের উপর ভরসা অনেক বেশি ছিল। পরিকল্পনা ছিল দেশে ফিরে এখানেই হার্ট সার্জারি করাবেন। কিন্তু সেই সময় আর পেলেন না।

    একবার ফোন করেছিলাম একটা অনুষ্ঠানে আসার জন্য। ওঁর সেক্রেটারি ফোন ধরে আমাকে চিনতে পারেননি। আমার খুব অভিমান হয়েছিল। পরে, যখন দেখা হলো, উনি আমার গাল টিপে দিতে এলেন অভ্যাস-মতো। আমি বলেছিলাম, ‘এ সব বাদ দিন। আপনার সেক্রেটারি তো আমাকে চিনতেই পারেন না।’ সবটা শুনে উনি অজস্র বার ক্ষমা চেয়েছিলেন। আমার অভিমান বোঝার সেই মানুষটা আর নেই।

    শুনেছি ঈশ্বর কখনও কখনও দুনিয়ায় একটা করে স্টার পাঠান। ওঁরা চলে গেলে জায়গাটা খালিই থাকে। মাইকেল জ্যাকসন এমন একটা স্টার ছিলেন। আমাদের রবিশঙ্করজি ছিলেন। আমার বন্ধু জাকির ভাইও এমন একজন ছিলেন। আমাদের কপাল ভালো আমরা ওঁর সান্নিধ্য পেয়েছি। নতুন প্রজন্মর কাছে উদাহরণ গড়ার মতো মানুষের সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে। জানি না আজকের প্রজন্ম আগামী দিনে কাদের নিয়ে গল্প করবে।
  • Link to this news (এই সময়)