তাঁর তবলার বোলে তখন মন্ত্রমুগ্ধ সকলে। উত্তরপাড়ার গঙ্গার ধারের ঐতিহ্যের জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরির মাঠ স্তব্ধ। সেই রকম এক চরম মুহূর্তে হঠাৎ থেমে গেলেন তিনি! কী হলো, কী হলো ভেবে চমকে উঠলেন শ্রোতারা। তবলা থামিয়ে শান্ত স্বরে জ়াকির হুসেন বলেছিলেন, ‘আপনি এ ভাবে সামনে ক্যামেরা নিয়ে ঘুরবেন না। ক্যামেরা এখানে রেখে দিয়ে যান। এ ভাবে ঘুরলে আমি বাজাতে পারব না। মন দিতে পারছি না।’
প্রায় তিরিশ বছর আগে ঘটনাটি ঘটেছিল উত্তরপাড়া সঙ্গীতচক্রের অনুষ্ঠানে। ১৯৯৫ সাল। জ়াকির হুসেন অনুষ্ঠান করতে এসেছিলেন উত্তরপাড়ায়। মোবাইল ফোন, মোবাইল ক্যামেরা তখন স্বপ্নের অতীত। সেই অনুষ্ঠানেই বড় ভিডিয়ো ক্যামেরা নিয়ে অনুষ্ঠানটি রেকর্ড করছিলেন সঙ্গীতচক্রের এক কর্তা। তখনই তবলা বাজানো থামিয়ে উপরের কথাগুলো বলেন জ়াকির।
শুধু একবার নয়, নয়ের দশকে উত্তরপাড়ার ঐতিহ্যশালী সঙ্গীতচক্রের অনুষ্ঠানে তিন–তিনবার এসেছিলেন জ়াকির। ষাটের দশকে তাঁর বাবা প্রবাদপ্রতিম তবলাশিল্পী উস্তাদ আল্লা রাখাও অনুষ্ঠান করে গিয়েছিলেন এখানে। কিংবদন্তির প্রয়াণে উত্তরপাড়ার মানুষদের মনে ফিরে আসছে তাঁর স্মৃতি। সেই সময়ে সঙ্গীতচক্রের সচিব ইন্দ্রনাথ পাল এখন ৭৫ বছরের বৃদ্ধ। তবু, সব কিছুই তাঁর মনে আছে ছবির মতো।
ইন্দ্রনাথবাবু বলছিলেন, ‘জ়াকির উত্তরপাড়ায় অনুষ্ঠান করতে খুব ভালোবাসতেন। আমার বেশ মনে আছে, ওঁকে দর্শকরা নানা রকম অনুরোধ করতেন। যেমন তবলায় ঘোড়ার খুরের আওয়াজ শোনাতে বলতেন। কখনও বলতেন, ট্রেন চলার মতো আওয়াজ করতে। জ়াকির হুসেন ওগুলো খুব ভালো করতে পারতেন। কিন্তু, আমাদের অনুষ্ঠানে এই অনুরোধ এলেই তিনি বলতেন, এ সব খুব সস্তা ধরনের ব্যাপার। উত্তরপাড়া সঙ্গীত চক্রের মতো এমন ঐতিহ্যশালী জায়গায় এই সব বাজাতে বলবেন না আমায়। এখানে আমি সেটাই বাজাব, যা আমি বাবার কাছে শিখেছি।’
সেই ‘শেখার’–ও গল্প আছে। ইন্দ্রনাথবাবু বলছিলেন, ‘আমরা একবার টেপ রেকর্ডারে ওঁর একটা ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম। সেখানে উনি বলেছিলেন, বাবা আল্লারাখা কী ভাবে তাঁকে রাত থেকে ভোর হওয়ার মুহূর্তে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে তবলা শেখাতেন। নানা প্রশ্ন করতেন। বলতেন, শেখার সেরা সময় এটাই। জ়াকির সাহেব আমাদের বলেছিলেন, তখন ঘুম পেত। কিন্তু, পরে বুঝেছিলাম ভোরবেলার ওই ঐশ্বরিক মুহূর্তে তবলা শেখার গুরুত্ব। যা আজও বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি।’
৯৫ সালেই শেষবার উত্তরপাড়ায় এসেছিলেন জ়াকির। শেষবারে আরও একটা ঘটনা ঘটেছিল। জ়াকির হুসেন প্রায় মাঝরাতে অনুষ্ঠান করতেন। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক বাজিয়ে ফেলেছেন। শ্রোতারা মুগ্ধ। কিন্তু পরে আরও শিল্পী অপেক্ষা করছিলেন। সচিব ইন্দ্রনাথবাবু স্টেজে গিয়ে অনুষ্ঠান একটু ছোট করার অনুরোধ করেন। আর কিছুক্ষণ বাজিয়ে নেমে আসেন জ়াকির সাহেব। ইন্দ্রনাথবাবুর কথায়, ‘স্টেজ থেকে নেমে আমাকে মারাত্মক বকেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, শ্রোতারা এই ভাবে শুনছিলেন, এত মুগ্ধ হয়ে, আপনারা সেখানে আমায় বাজাতে দিলেন না! আমরা তখনই ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলাম।’
জ়াকির চলে গেলেন। রয়ে গেল তাঁর স্মৃতি। উত্তরপাড়ায় গঙ্গার ধারে জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরির মাঠে কান পাতলে আজও যে শোনা যায় কিংবদন্তির তবলার বোল!