• শিলিগুড়িতে লিথিয়াম–আয়ন ব্যাটারির স্টার্টআপ দুই তরুণের
    এই সময় | ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪
  • সঞ্জয় চক্রবর্তী, শিলিগুড়ি

    লিথিয়াম–আয়ন ব্যাটারি তৈরির স্টার্টআপ সংস্থা। শিলিগুড়িতে পূর্ব ও উত্তর–পূর্ব ভারতের একমাত্র লিথিয়াম–আয়ন ব্যাটারি অ্যাসেম্বলিং কারখানা গড়েছেন দুই তরুণ— সৌভিক দাশগুপ্ত ও দেবেন্দ্র আনন্দ ঢোলে। তাঁদের সংস্থা ‘লিওনার্জি’–র অ্যাসেম্বল করা লিথিয়াম–আয়ন ব্যাটারি বিক্রি হচ্ছে শিলিগুড়ি থেকে গুয়াহাটি, মায় পাটনাতেও।

    মাত্র সাত মাসে ১০ লক্ষ টাকার ব্যবসা করে ফেলেছে সংস্থাটি। সৌভিকের কথায়, ‘এটা কিছুই নয়। একটু সরকারি সহায়তা পেলে আগামী এক বছরে আমরা ৫০ কোটি টাকার ব্যবসা করতে পারব।’ দেবেন্দ্র ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু কারও অধীনে চাকরি করবেন না বলে ব্যবসা করেন। মুম্বইয়ে নিজের শেয়ার ব্রোকিংয়ের ব্যবসা আছে। সৌভিকের প্রথম জীবনে সেলসের কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে। এখন বিল্ডার।

    দেবেন্দ্র ব্যাটারি অ্যাসেম্বলিং কারখানার কাজের তদারকি করেন। সৌভিক দেখেন মার্কেটিং। দিনে গড়ে প্রায় ২০০ ব্যাটারি তৈরি হচ্ছে। সৌভিকের স্ত্রী শিলিগুড়িতে চাকরি করেন। কোভিডের আগে শিলিগুড়িতে স্ত্রীর কাছে গিয়েছিলেন কলকাতার আদি বাসিন্দা সৌভিক। সে সময়েই শিলিগুড়ির রাস্তায় হাজার হাজার টোটো দেখে তাঁর মাথায় লিথিয়াম–আয়ন ব্যাটারি তৈরির কারখানার পরিকল্পনার কথা মাথায় আসে। আলোচনা করেন কলেজ জীবনের বন্ধু দেবেন্দ্রর সঙ্গে। দুজনে মিলে গড়ে তোলেন ‘লিওনার্জি’।

    ২০২০ সালে শিলিগুড়ির ইস্টার্ন বাইপাস সংলগ্ন এলাকায় দেড় বিঘা জমি কিনে কারখানা তৈরি করেন তাঁরা। রাজ্য সরকারের এমএসএমই দপ্তর থেকে প্রাথমিক পর্বে নানা ভাবে সৌভিকদের গাইড করা হয়। পাশে দাঁড়ান ব্যবসায়ী সংগঠন ফেডারেশন অব চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ়, নর্থ বেঙ্গল (ফোসিন)–এর কর্তাব্যক্তিরা।

    কিন্তু, কোনও ব্যাঙ্ক ঋণ দিতে রাজি হয়নি। সৌভিকরা পিছিয়ে আসেননি। একটি বেসরকারি সংস্থা থেকে নেওয়া ঋণ আর নিজেদের পুঁজি একত্র করে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন এই ব্যবসায়। ২০২৩ থেকে কারখানায় অ্যাসেম্বলড লিথিয়াম–আয়ন ব্যাটারির উৎপাদন হচ্ছে। বাজারে বিক্রিও সংস্থার পক্ষে আশাব্যঞ্জক। কিন্তু, এত ব্যবসা থাকতে হঠাৎ লিথিয়াম–আয়ন ব্যাটারি তৈরির স্টার্টআপ সংস্থা গড়ার সিদ্ধান্ত কেন?

    সৌভিকের ব্যাখ্যা, শিলিগুড়ি–সহ গোটা উত্তরবঙ্গে কয়েক লক্ষ টোটো চলে। লেড অ্যাসিড ব্যাটারিতে চলে বেশিরভাগ টোটো। কিন্তু, লেড অ্যাসিড ব্যাটারিতে বিস্ফোরণ হওয়া বা আগুন লাগার ভয় রয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণ খরচও বেশি। লিথিয়াম–আয়ন ব্যাটারিতে সে সব ভয় নেই। তিনি বলেন, ‘ভালো মানের লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি হলে অন্তত পাঁচ বছর চোখ বুজে চলে যাবে। অথচ, পূর্বাঞ্চলে লিথিয়াম–আয়ন ব্যাটারির উৎপাদন হয় না। দিল্লি থেকে পুরোটা সরবরাহ হয়। এ সব দেখেই আমরা লিথিয়াম–আয়ন ব্যাটারি অ্যাসেম্বলিং কারখানা তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিই।’

    দেবেন্দ্রর সংযোজন, ‘একটা অ্যাসেম্বলড লিথিয়াম–আয়ন ব্যাটারির যতটা বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা হওয়া উচিত, সেটা সব সংস্থার ব্যাটারিতে থাকে না। আমাদের ব্যাটারিতে সেই বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে।’

    অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মে একটা কারখানা আরও দশটা ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি করে। সৌভিক-দেবেন্দ্রর হাত ধরে উত্তরবঙ্গে অ্যাসেম্বলড লিথিয়াম–আয়ন ব্যাটারির ডিলারশিপ, চার্জিং পয়েন্ট পরিষেবা–সহ নানা ব্যবসার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এখন গোটা বিশ্বে লিথিয়ামের বেশিরভাগটাই লাতিন আমেরিকায় উৎপাদিত হয়। তবে লিথিয়াম–আয়ন ব্যাটারি তৈরিতে সবচেয়ে এগিয়ে চিন। ভারতে বছরে প্রায় ৩ লক্ষ কন্টেনার লিথিয়াম–আয়ন ব্যাটারি আমদানি হয় চিন থেকে।

    আমেরিকা এবং ভিয়েতনাম থেকে আসে যথাক্রমে ৫০,০০০ ও ১০,০০০ কন্টেনার। বিশেষজ্ঞমহলের মতে, ভারতে লিথিয়াম–আয়ন ব্যাটারি উৎপাদন শুরু হলে দাম এখনকার থেকে প্রায় ৪০ শতাংশ কমে যাবে। এখন একটা টোটোর অ্যাসেম্বলড লিথিয়াম–আয়ন ব্যাটারির দাম পড়ে ৭০ হাজার টাকার মতো। ভারতে লিথিয়াম–আয়ন ব্যাটারি উৎপাদন শুরু হলে আনুপাতিক হারে অ্যাসেম্বলড ব্যাটারিও সস্তা হবে। সৌভিকদের একটাই দুঃখ, এমন একটা সম্ভাবনাময় শিল্প নিয়ে রাজ্য সরকারের খুব বেশি আগ্রহ নেই। এমনকী, কোনও পলিসিও নেই যাতে নতুনরা নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারে।

    সৌভিক বলেন, ‘রাজ্য সরকার এই শিল্পটাকে একটু সাহায্য করলে কেবলমাত্র জিএসটি বাবদই সরকারের বছরে ৫০০ কোটি টাকা আয় হতে পারে।’ কয়েক বছর আগে শিলিগুড়ির ফাঁসিদেওয়াতে লেড অ্যাসিড ব্যাটারির একটা ক্লাস্টার তৈরি করা হয়েছিল।

    সে সময়ে সরকার ওই কারখানাগুলিকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছিল। সে রকমই সহায়তা চাইছে লিওনার্জি। সরকারি সহায়তা না মিললেও হাল ছাড়তে রাজি নন সৌভিক-দেবেন্দ্র। উত্তর–পূর্বের বাজার ধরতে নেমে পড়েছেন তাঁরা। সৌভিক-দেবেন্দ্রকে নিয়ে রীতিমতো গর্বিত ফোসিনের সম্পাদক বিশ্বজিৎ দাস। তিনি বলেন, ‘তরুণ প্রজন্মই আমাদের দেশের শিল্পের ভবিষ্যৎ। ওই দুই তরুণ যোগাযোগ করলে ব্যাঙ্ক নিয়ে সমস্যা মেটাতে সাহায্য করতে পারি।’
  • Link to this news (এই সময়)