সুমন ঘোষ
১০৫ বছর আগের কথা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজতে শুরু করতেই তৈরি হয়েছিল ৪৯ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্ট। গ্রাম বাংলার বহু যুবক সেই রেজিমেন্টে নাম লিখিয়ে চলে যান যুদ্ধে। কেউ ফিরে আসেন, কেউ আর কখনই ফেরেননি। যাঁরা ফিরেছিলেন, স্বীকৃতি হিসেবে তাঁদের কাছে পৌঁছেছিল ব্রিটিশ সরকারের মেডেল।
পশ্চিম মেদিনীপুরের দাঁতনের প্রত্যন্ত গ্রাম আঙ্গুয়া। সেখানে বিশ্বজিৎ জানার খড়ের চাল থেকে পাওয়া গিয়েছে বিশ্বযুদ্ধের এমনই দুটো মেডেল। একটা ১৯১৯–এর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের। আর একটি ১৯৪৫–এর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। মেডেল দু’টি খুঁজে পেয়েছেন বিশ্বজিৎ। আজ নয়, প্রায় ৮–১০ বছর আগেই। তবে থেকে সেই মেডেল দু’টি রয়েছে দাঁতনের ‘দন্ডভুক্তি একাদেমি’–তে। যেখানে সংরক্ষিত থাকে ফেলে আসা ইতিহাসের স্মারক। মজার কথা, আজও কিন্তু জানা যায়নি, কী ভাবে বিশ্বজিতের বাড়িতে এলো দু’টি মেডেল। কারণ, আজও বিশ্বজিৎ হাত উল্টে বলছেন, ‘আমাদের বাড়ি থেকে কেউ যুদ্ধে গিয়েছিলেন, এমন তো বাপ–ঠাকুর্দার আমলে শুনিনি।’
যেহেতু দু’টি বিশ্বযুদ্ধেরই মেডেল রয়েছে, তাই ওই বাড়ির একাধিক সদস্য দু’টি বিশ্বযুদ্ধেই অংশ নিয়েছিলেন বলে মনে করছেন ইতিহাসবিদরা। হতে পারে, বিশ্বজিতের কোনও পূর্বপুরুষের কোনও আত্মীয় বা পরিচিত কেউ যুদ্ধে গিয়ে ওই মেডেল পেয়েছিলেন। যা কোনও ভাবে এসে পড়েছিল আঙ্গুয়ায়। গুরুত্ব হারিয়ে তার জায়গা হয়েছিল খড়ের চালায়। নকল নয়তো? দণ্ডভুক্তি একাদেমির শিক্ষক ও গবেষক সন্তুকুমার জানা বলেন, ‘আমরা দেখেই বুঝতে পেরেছি, এগুলি বিশ্বযুদ্ধের স্মারক।’
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হয়েছিল ১৯১৪-১৯১৮ পর্যন্ত। ইতিহাসবিদরা বলছেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মেডেলটি ১৯১৯–এ দেওয়া হয়। এটা তামার। যার একপিঠে রাজা পঞ্চম জর্জের মুখাবয়ব রয়েছে। সেখানে লেখা, 'KING GEORGE V EMPEROR'। আর অপর পিঠে রয়েছে এক আহত ভারতীয় সৈনিকের ছবি। যাঁকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন আর একজন। সেখানে লেখা 'FOR FREEDOM AND HONOUR'।
সন্তুকুমারের অনুমান, বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধীনে দাঁতনের কেউ হয়তো যুদ্ধে গিয়ে এই মেডেল পেয়েছিলেন। ইতিহাস ঘেঁটে তাঁর সংযোজন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার দু’জন সৈনিকের মৃত্যু ঘটেছিল। ৪৯ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্টের ওই দুই সৈনিক — ২৭৫ নম্বর সিপাই সতীশচন্দ্র সাঁতরা (মৃত্যু তারিখ অজানা) ও ৩৩৪ নম্বর সিপাই জ্যোতিন্দ্রনাথ সেন (মৃত্যু-৫ সেপ্টেম্বর ১৯১৭)। জেলা থেকে যাওয়া যে সৈনিকরা আহত হয়েছিলেন, তাঁদের তালিকা দীর্ঘ এবং বিস্তারিত তথ্য নেই। ফলে, এই মেডেলের মালিককে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, দাবি ইতিহাসবিদদের।
অপরদিকে, ১৯৩৯–এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ জুড়ে একাধিক রেজিমেন্ট তৈরি করে ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দেয়। বহু সৈনিকের মৃত্যু হয়। ১৯৪৫–এ যুদ্ধ শেষে যাঁরা ফিরে আসেন, স্বর্ণ এবং রৌপ্য পদকে ভূষিত করা হয় তাঁদের। রাজা ষষ্ঠ জর্জের আমলের এরকমই একটি দুষ্প্রাপ্য রৌপ্য মেডেলও বিশ্বজিতের বাড়ি থেকে মিলেছে। মেডেলটির এক পিঠে রাজা ষষ্ঠ জর্জের মুখাবয়ব। সঙ্গে লেখা 'GEORGE VI G:BR:OMN: REX ET INDIAE IMP:'। উল্টোপিঠে এক ব্রিটিশ সিংহ দ্বিমুখী ড্রাগনের উপরে আক্রমণরত অবস্থায় দাঁড়িয়ে। তাতে লেখা '1939-45'। সিংহের পায়ের কাছে ক্ষুদ্র আকারে খোদিত রয়েছে ECRP। অর্থাৎ Edward Carter Preston এই মেডেলের নক্সা বানিয়েছিল।
আঙ্গুয়ার বিশ্বজিৎ কাতর স্বরে বলছেন, ‘শুনেছি, পূর্বপুরুষদের একজন কেউ ইংরেজ আমলে চৌকিদার ছিলেন। সে তো চৌকিদার, তাঁর তো যুদ্ধে যাওয়ার কথা ছিল না। যে মেডেলগুলি পাওয়া গিয়েছে, সেগুলির গুরুত্ব পরিবারের কেউ বুঝতেন না। বহুদিন তা খড়ের চালে রাখা ছিল। পরে কিছুদিন পুরোনো দিনের তোরঙে স্থান হয় তাদের। সন্তু স্যার কয়েন সংগ্রহ করেন বলে শুনেছিলাম। তাই তাঁকে দিয়েছিলাম। উনি বলার পর জেনেছি তার গুরুত্ব। আমিও অবাক! আজও জানি না, কী ভাবে এই মেডেল আমাদের বাড়িতে এলো।’
এখানেই শেষ নয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আরও একটি মেডেল মিলেছে আঙ্গুয়া গ্রাম থেকেই। যেটি আসলে Peace Celebration Medal। ১৯১৯–এ বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্ত হলে রাজা পঞ্চম জর্জ ভারতবর্ষের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই মেডেল পাঠিয়েছিলেন বলে ইতিহাসবিদরা জানিয়েছেন। যার এক পিঠে জ্ঞানবৃক্ষের চিত্র এবং অপর পিঠে রাজা পঞ্চম জর্জ এবং রাণী মেরীর মুখাবয়ব। আঙ্গুয়া থেকে পাওয়া ওই মেডেলটি কলকাতা জ়োনের বিদ্যালয়ের জন্য নির্ধারিত ছিল বলে অনুমান। কারণ, তাতে খোদিত রয়েছে 'Calcutta Schools'।
দাঁতন থেকেই মিলেছে মোঘল সম্রাটদের সময়কালীন মুদ্রাও। ২০১৪–য় দাঁতন-১ ব্লকের ৪ নম্বর শালিকোঠা গ্রাম পঞ্চায়েতের গাজীপুর কিসমৎ গ্রামের বাসিন্দা উজ্জ্বল দাসের বাড়ি থেকে বংশ পরম্পরায় সংরক্ষিত একটি মোঘল মুদ্রা উদ্ধার করেছে দণ্ডভুক্তি একাদেমি। সেটি ১৮৩১–এর। মোঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের রাজত্বের ৩৭তম বর্ষের সময়কালীন 'এক পাই সিক্কা' তাম্রমুদ্রাটিও বর্তমানে দাঁতনের দণ্ডভুক্তি একাদেমি–র সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত রয়েছে। মুদ্রাটির এক পিঠে ফার্সি লিপিতে লেখা — 'সানা জুলুস ৩৭ শাহ আলম বাদশা'। অপর পিঠে বাংলা, ফার্সি এবং গুজরাটি হরফে লেখা — 'এক পাই সিক্কা'।