• মাটিতে পা রেখে আকাশ ছোঁয়ার দিকে অভিজিৎ
    এই সময় | ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪
  • সুদীপ দত্ত, শিলিগুড়ি

    যদি নিজেকে নিয়ে একটা গল্প লিখতেন, তা হলে সেই গল্প বলত একজন যুবকের কথা। যিনি পারিবারিক ও আর্থিক কারণে একদিন কলকাতা ছেড়ে চলে এসেছিলেন শিলিগুড়িতে। তখন বয়স ২১ বছর। সেই সময় যুবকটি জীবনসংগ্রামে টিকে থাকার মরণপণ লড়াই চালাচ্ছেন। হঠাৎ একটি বিজ্ঞাপন তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল।

    শিলিগুড়ির ‘উত্তাল’ নাট্যদলে অভিনয়ের জন্য নতুন ছেলেমেয়ে নেওয়া হবে। এই বিজ্ঞাপনটি চোখে পড়ে ওই যুবার। অভিনয় আর পারিশ্রমিক, দু’টি মানদণ্ডেই তাঁর স্বপ্ন সার্থক করেছিল ‘উত্তাল’। ধীরে ধীরে বাচিক শিল্পে তাঁর আগ্রহ বাড়তে থাকে। এর পর গত দু’দশকে শুধু উত্তরণের কাহিনি। এই কাহিনি শিলিগুড়ির দেশবন্ধু পাড়ার অভিজিৎ শ্রীদাসের।

    বাচিক শিল্পী হিসেবে ক্রমশ পারঙ্গম হয়ে ওঠেন অভিজিৎ। শিলিগুড়ির একটি স্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেলে উপস্থাপক হিসেবে কাজ করার সুযোগও মিলে যায়। এরপর বেতার। আকাশবাণীর মুক্তি চন্দের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি সত্যি সত্যিই আত্মপ্রকাশ করেন শিলিগুড়ির বেসরকারি স্টেশনের ‘রেডিয়ো জকি’ হিসেবে।

    কয়েক বছর পর আবার ইচ্ছেবদল। এ বার অ্যাড ফিল্মের পরিচালক হওয়ার সাধ। বিজ্ঞাপন তৈরি করতে করতে তিনি হঠাৎই কাজ করার সুযোগ পেয়ে যান সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শর্মিলা ঠাকুর, সোহা আলি খান, মনোজ তিওয়ারি প্রমুখ প্রথিতযশা শিল্পীর সঙ্গে।

    অভিজিতের ইচ্ছে ছিল চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া। এই মাধ্যমে মানুষকে বার্তা দেওয়া। মেইনস্ট্রিম সিনেমা তৈরি করা উত্তরবঙ্গ থেকে। কিন্তু, সিনেমার স্ক্রিপ্ট কে লিখবেন?

    আবারও নিজেকে আবিষ্কার করেন তিনি। নিজেই লিখে ফেলেন গল্প। শর্মিলা ঠাকুরের সঙ্গে কিছুটা পরিচয় থাকার সুবাদে তিনি রাজি হন স্ক্রিপ্ট শুনতে। তারপর সম্মতিও জানান মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করার জন্য। তাঁর বিপরীতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় অতিমারি। জীবনাবসান হয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। টানাপড়েনে অনিশ্চয়তার মেঘ জমেছিল ছবির ভবিষ্যতে।

    কিন্তু স্বপ্নের পিছু ছাড়েননি অভিজিৎ। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাঁর ছবির মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করতে রাজি হন জয়া বচ্চন এবং দীপঙ্কর দে। কিন্তু আবার এই নামে বদল আসে। দীপঙ্কর দে-র বিপরীতে মমতাশঙ্কর। ‘বিজয়ার পরে’ ছবিটিতে এই দু’জনের সঙ্গে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়। ছবির প্রযোজক ছিলেন শিলিগুড়িরই এক বিশিষ্টজন— পরিবেশবিদ, শিক্ষাবিদ এবং সমাজকর্মী সুজিত রায়।

    এ বছরেই মুক্তি পায় ‘বিজয়ার পরে’। গত বছর কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে ছবির প্রিমিয়ার হয়। এখনও পর্যন্ত দেশ–বিদেশের বহু চলচ্চিত্র উৎসবে বিভিন্ন বিভাগে পুরস্কার পেয়েছে এই ফিল্ম। ছবির বক্তব্য কী? অভিজিৎ বলেন, ‘দুর্গাপুজোর প্রেক্ষাপটে একটা পরিবারের গল্প। সেখানে জীবন আর মৃত্যুই শেষ কথা। তারই মধ্যে জীবনের সমস্ত আক্ষেপ সংক্ষিপ্ত করে নেওয়া।’

    না, অভিজিতের গল্প এখানেই শেষ নয়! সম্প্রতি তাঁর নির্দেশনায় প্রথমবার কোনও বিজ্ঞাপনের ছবিতে অভিনয় করলেন মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়। অভিনয়ে ছিলেন সোনাক্ষী সিনহাও। সেই যুবকের চলা এখনও শেষ হয়নি। এরপর কী পরিকল্পনা? অভিজিৎ বলেন, ‘উত্তরবঙ্গে থেকে উত্তরবঙ্গকে নিয়ে ছবি তৈরি করব। এটাই আমার ইচ্ছে।’ এই গল্প, স্ক্রিপ্ট, কাস্টিং— সব কিছু নিয়েই তিনি এখন গভীর ভাবনায়। নিজেকে নিয়ে সত্যিই গল্প লিখলে তার নাম কী দিতেন অভিজিৎ? হেসে ফেলেন তিনি। একটু থমকে বলেন, ‘চোখে থাকুক আকাশ, কিন্তু পা ছুঁয়ে থাক মাটি।’

  • Link to this news (এই সময়)