• বাংলাদেশের একরত্তিকে বাঁচিয়ে দিল কলকাতা
    এই সময় | ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪
  • এই সময়: অত্যাধুনিক চিকিৎসার জন্য সারা বছরই কাতারে কাতারে রোগী ও পার বাংলা থেকে আসেন এ পার বাংলায়। কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে বছরভরই বাংলাদেশী রোগীর ভিড় লেগে থাকে। কিন্তু পড়শি দেশের বর্তমান অশান্ত পরিস্থিতির কারণে ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রবল কড়াকড়ি শুরু করেছে ভারত সরকার।

    নিতান্তই জরুরি ও গুরুতর অসুস্থতা ছাড়া বাংলাদেশী রোগী এ দেশে আসার ভিসা পাচ্ছেন না বলে এখানকার হাসপাতালগুলিতেও ও পার বাংলার রোগীর সংখ্যায় প্রবল ভাটার টান। প্রায় ৮০–৯০% কমেছে রোগী।

    এই আবহে বাংলাদেশের একরত্তির জীবনদায়ী অপারেশন হলো ইএম বাইপাস লাগোয়া আনন্দপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে। জটিল নিউরোসার্জারির পরে আপাতত সুস্থ সেই ৯ মাসের শিশুপুত্র দেশে ফেরার অপেক্ষায়। যশোরের ৯ মাসের একরত্তি রিদওয়ান হাবিব ইলহামের মা–বাবা গত কয়েক মাস ধরেই লক্ষ্য করছিলেন, বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শিশুর মাথার খুলির আকার ক্রমেই যেন বিকৃত হয়ে যাচ্ছে।

    স্থানীয় ডাক্তাররা জানান, বিরল এক জন্মগত অসুখের শিকার রিদওয়ান। ডাক্তারি পরিভাষায় যার নাম, ক্রেনিয়ো–সাইনোস্টোসিস। ২০ হাজারে একজনের হতে পারে। এতে খুলির ছোট ছোট হাড়গুলি বেখাপ্পা ভাবে জুড়ে গিয়ে বিকৃত মাথার জন্ম দেয়। বাংলাদেশের চিকিৎসকরা একরত্তির মা–বাবাকে কলকাতায় যাওয়ার পরামর্শ দেন। কারণ, মাথা স্বাভাবিক করার জন্য অস্ত্রোপচারের পরিকাঠামো সে দেশে নেই।

    রিদওয়ানকে নিয়ে বাবা আসান হাবিব রুবেল আনন্দপুর ফর্টিস হাসপাতালে আসেন। এক্স–রে ও সিটি স্ক্যানে দেখা যায়, খুলির বাঁ দিকটা যেন তুবড়ে রয়েছে। তড়িঘড়ি অস্ত্রোপচারের প্রস্তুতি নেন ফর্টিসের প্রধান নিউরোসার্জেন জিআর বিজয়কুমার। সাড়ে চার ঘণ্টার লম্বা অপারেশনে ত্রুটিপূর্ণ ভাবে জুড়ে যাওয়া খুলির হাড়গুলিকে কেটে পুনর্গঠন করেন তিনি। সফল অস্ত্রোপচারে এখন রিদওয়ানের খুলি আর পাঁচ জন সমবয়সির মতোই গোলাকার।

    বিজয়কুমার জানান, যথাসময়ে চিকিৎসা না–হলে ওই শিশুর চেহারাই যে শুধু খারাপ লাগত তা নয়, মস্তিষ্কের বৃদ্ধি ও স্নায়বিক নানা সমস্যাও দুর্বিষহ করে তুলতে পারত জীবন। ছিল প্রাণহানির শঙ্কাও। ফর্টিস হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছেন, ইদানীং খুবই কমে গিয়েছে বাংলাদেশী রোগী। মাসে চার–পাঁচশো’র বদলে মাত্র ৩০–৩৫ জন রোগীরই চিকিৎসা হচ্ছে। তার মধ্যে রিদওয়ানকে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ নিয়ে সুস্থ জীবনে ফেরানো সম্ভব হয়েছে।

    ফর্টিসেরই মতো বাংলাদেশী রোগীর সংখ্যা শহরের আর পাঁচটা হাসপাতালেও ব্যাপক ভাবে কমে গিয়েছে। বিপি পোদ্দার হাসপাতালের গ্রুপ অ্যাডভাইজ়ার সুপ্রিয় চক্রবর্তী জানাচ্ছেন, গত বছর নভেম্বর-ডিসেম্বরে বাংলাদেশ থেকে যত রোগী এসেছিলেন, এই বছর সেই সংখ্যাটা প্রায় ৮০% কমেছে। গত চার সপ্তাহে ১৫টি বড় অপারেশন হয়েছে। প্রায় ৩৫টি পরিকল্পিত অস্ত্রোপচারের মধ্যে তিনটি ছাড়া প্রায় সব বাতিল হয়ে গিয়েছে। আউটডোরেও বাংলাদেশে রোগী প্রায় ৯০% কমেছে।

    সুপ্রিয় বলেন, ‘বড়দিন-বর্ষবরণের এই সময়টায় বাংলাদেশের রোগীরা সাধারণত পরিকল্পিত অস্ত্রোপচার করাতে আসেন। মূলত হিপ রিপ্লেসমেন্ট, নি রিপ্লেসমেন্ট, মাইক্রোস্কোপিক স্পাইন সার্জারি ইত্যাদি হয় তাঁদের। আমাদের হাসপাতালেও বছরের শেষ ১০ দিনে অন্তত ৫০টি অপারেশন হওয়ার কথা ছিল। আপাতত সবই স্থগিত। তবে সব রোগীদের সঙ্গে নিরবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ রাখা হচ্ছে।’

    অন্যত্রও সেই একই ভাটার ছবি। পিয়ারলেস হাসপাতালের সিইও সুদীপ্ত মিত্র বলেন, ‘গত একমাসে মোট ১,২৮৯ জন বাংলাদেশের রোগী এসেছেন আমাদের হাসপাতালে। অথচ গত বছর ঠিক এই সময় অন্তত ৩,১০০ রোগী এসেছিলেন ও পার বাংলা থেকে। সম্প্রতি গোটা দশেক অপারেশন হয়েছে বাংলাদেশী রোগীর। কোনওটিই জটিল নয়।’

    স্বাস্থ্য মহল সূত্রে খবর, আগে বাংলাদেশ থেকে সাধারণ মেডিক্যাল ভিসা নিয়ে আসতেন রোগীরা। তার পরে পছন্দের এক বা একাধিক জায়গায় চিকিৎসা করাতেন। কিন্তু এখন ছবিটা অন্য। এখন নির্দিষ্ট হাসপাতালে ভিসা ইনভিটেশন লেটার (ভিআইএল)-এর মাধ্যমেই ভিসা হয়। ফলে নির্দিষ্ট ওই হাসপাতালেই চিকিৎসা হয় সংশ্লিষ্ট রোগীর। পূর্বতন আমরি গোষ্ঠী, কলাম্বিয়া এশিয়া এবং মেডিকা গোষ্ঠীর মালিকানা এখন মণিপালের হাতে। শহরে পাঁচটি হাসপাতাল রয়েছে তাঁদের। ওই হাসপাতাল গোষ্ঠী সূত্রে জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে রোগীরা আসতে পারছেন না বলে এখন তাঁরা পুরোনো রোগীদের জন্য টেলিমেডিসিন পরিষেবা দিচ্ছেন।

    ডিসান হাসপাতালের এক মুখপাত্র জানাচ্ছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে তাঁরাও বাংলাদেশী রোগীদের জন্য অনলাইন কনসাল্টেশনের ব্যবস্থা রেখেছেন। তিনি জানান, গত দেড়মাসে দেড়শোরও বেশি ভিআইএল ইস্যু করা হয়েছে। কিন্তু মাত্র ২২ জন বাংলাদেশী রোগী মেডিক্যাল ভিসা পেয়ে ডিসানে চিকিৎসা করাতে এসেছেন। তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই হৃদরোগ ও ক্যান্সারের রোগী। কিছু রোগী এসেছে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ দেখাতে।

  • Link to this news (এই সময়)