• মহাশ্বেতা দেবীর স্বপ্ন পূরণে উদ্যোগ
    বর্তমান | ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪
  • পিনাকী ধোলে, বরাবাজার: খবরটা শুনলে তিনি নিশ্চয়ই খুশি হতেন। পুলিসের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগ ছিল, শবরদের দমন পীড়নের। সেই পুলিসই এগিয়ে এসেছে তাঁর শেষ স্বপ্ন পূরণ করতে। প্রয়াত সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী চেয়েছিলেন শবরদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ুক জ্ঞানের আলো। তাই শবর শিশুদের জন্য তৈরি করেছিলেন একাধিক শিক্ষাকেন্দ্র। কিন্তু ২০১৬ সালে তাঁর মৃত্যুর পর অর্থের অভাবে কার্যত বন্ধ হতে বসেছিল সেইসব শিক্ষাকেন্দ্রগুলি। সেই শিক্ষাকেন্দ্রগুলিকে ফের বাঁচিয়ে তুলেছে পুরুলিয়া জেলা পুলিস। 


    ঘড়ির কাঁটায় তখন প্রায় বিকেল পাঁচটা। বরাবাজার থানার হিজলাগ্রামের শবর শিশু বিকাশ কেন্দ্র পড়ুয়াদের কোলাহলে মুখরিত। দেখা গেল শিশুদের ক্লাস নিচ্ছেন পুলিসেরই এক কর্মী। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এই শিক্ষাকেন্দ্রটি মহাশ্বেতা দেবীর তৈরি। তাঁর মৃত্যুর পর এটির দায়িত্ব নিয়েছে পুরুলিয়া জেলা পুলিস। প্রতিদিন বিকেল হলেই পড়ুয়াদের বাড়িতে ডাকতে যান তিনি। অনেকে আসে, অনেকে আসতে চায় না। ওই পুলিস কর্মী বলছিলেন, সম্প্রতি পড়ুয়ার সংখ্যা কিছুটা কমেছে। শিশুদের সঙ্গে নিয়ে তাদের বাবা-মা ধান কাটতে, ইটভাটায় কাজ করতে ভিন জেলায় পাড়ি দিয়েছে। তবে প্রতিকূলতা সত্ত্বেও যত বেশি সংখ্যক পড়ুয়াকে পাঠশালায় আনা যায়, সেই চেষ্টাই করেন তিনি।


    পুরুলিয়া জেলা পুলিস সূত্রের খবর, বরাবাজার থানা এলাকাতেই মহাশ্বেতা দেবীর তৈরি এরকম অন্তত আটটি শিশুশিক্ষা কেন্দ্র রয়েছে। ২০১৬ সালে জ্ঞানপীঠ জয়ী সাহিত্যিকের মৃত্যুর পর সেগুলির দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয় পুরুলিয়া জেলা পুলিস। স্কুলগুলির পরিচালনায় রয়েছে বরাবাজার থানা। পুলিসের কর্মীরাই সেগুলির শিক্ষক। বিকেলে স্কুল ছুটির পর শিশুদের বাড়িতে ডাকতে যান তাঁরা। টিফিনে দেওয়া হয় গুড়-মুড়ি। মহাশ্বেতার স্বপ্নের চিড়কুন্ডির শবর শিশু বিকাশ কেন্দ্রের শিক্ষক পুলিস কর্মীর কথায়, এলাকা থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। অনেক শবর শিশুই সেখানে যায় না। সকাল হলেই মাঠেঘাটে ঘুরে ইঁদুর মেরে বেড়ায়। তা বলে শিক্ষার আলো থেকে তারা কেউ বঞ্চিত নেই।


    জেলার পুলিস সুপার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ওই আটটি স্কুল ছাড়াও পরবর্তীতে জেলা পুলিসের উদ্যোগে আরও চারটি শবর শিক্ষাকেন্দ্র খোলা হয়েছে। সবমিলিয়ে প্রায় চারশোর বেশি পড়ুয়া রয়েছে। পুঁথিগত পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক বিষয়েও আমরা তাদের পাঠ দিয়ে থাকি। আত্মরক্ষার জন্য শবর মেয়েদের আমরা ক্যারাটে শেখাচ্ছি। বরাবাজার থানার আইসি পার্থসারথি চক্রবর্তী বলেন, শবর শিশুদের শিক্ষার বিকাশে আমরা সবরকম চেষ্টা করছি। আমাদের এই উদ্যোগে একাধিক এনজিওকেও পাশে পেয়েছি। পশ্চিমবঙ্গ খেড়িয়া শবর কল্যাণ সমিতির অধিকর্তা প্রশান্ত রক্ষিত বলেন, শিক্ষাকেন্দ্র চালাতে গেলে তো পুঁজি লাগে। মহাশ্বেতাদেবীর মৃত্যুর পর বারাবাজার থানার তত্কালীন ওসির সঙ্গে আমাদের সংগঠনের কথা হয়। তারপর থেকেই শিক্ষাকেন্দ্রগুলি পুলিস পরিচালনা করছে। 


    স্থানীয় সূত্রের খবর, এক সময়ে শবরদের ভুল বুঝিয়ে দুষ্কৃতীরা নিজেদের কুকর্মে ব্যবহার করত। অন্ধকার রাস্তায় ফেলে রাখা হতো ফালি। সেই ফালিতে লেগে গাড়ির চাকা ফেটে যেত। তারপরই চলত অবাধে লুট। এই অপরাধে শবরদের উপর পুলিসের দমন পীড়নও চলত। তবে, পালাবদলের পর থেকে একটু একটু করে পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। এক সময়ে যে পুলিস দেখলে শবররা ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যেত বলে শোনা যায়, সেই পুলিসই এখন তাদের ভালোমন্দের দেখভাল করছে।
  • Link to this news (বর্তমান)