• বাসের স্টিয়ারিং ধরা হাতেই উঠল বিচারের ‘হাতুড়ি’,  নিমতার প্রতিমা হলেন একদিনের বিচারক
    বর্তমান | ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪
  • সুকান্ত বসু, কলকাতা: কলমের এক খোঁচায় জরিমানার অঙ্ক লিখলেন। সই করলেন নথিতে। সামনে বাস মালিক কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে। বিচারক প্রতিমা পোদ্দার বললেন, ‘যান এবার অল্পে রেহাই দিলাম। এরকম আর করবেন না।’


    নিজের কর্মজীবনে বাস চালকের আসনে বসে কতই না জরিমানা দিতে হয়েছে তাঁকে। এদিন বিচারকের আসনে বসে তিনিই কি না লিখছেন অন্যের জরিমানার ফরমান! লোক আদালতে বিচারকের আসনে বসে থাকা প্রতিমাদেবীকে তখন দেখে চেনা দায়। মুখ গম্ভীর। দৃষ্টি স্থির। ধৈর্য ধরে শুনছেন কৌঁসুলিদের সওয়াল-জবাব। নোট নিচ্ছেন। সহ বিচারকদের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করছেন শাস্তি। অন্যান্য দিন শহরের রাস্তায় তাঁকে মিনিবাস চালকের ভূমিকায় দেখা যায়। পরেন সাধারণ সালোয়ার-কামিজ। এদিন চোখে সরু ফ্রেমের চশমা। শাড়ির উপর সোয়েটারটা ব্লেজারের মতো দেখতে লাগছে। 


    উত্তর ২৪ পরগনার নিমতায় থাকেন ৫২ বছরের প্রতিমা পোদ্দার। শনিবার কলকাতার লোক আদালতে তিনি একদিনের বিচারকের পদ অলঙ্কৃত করলেন। কলকাতার কিরণশঙ্কর রায় রোডে সিটি সিভিল কোর্ট ভবনে বসেছিল বছরের শেষ লোক আদালত। ছিল তিন সদস্যের বেঞ্চ। প্রতিমাদেবী ছিলেন বেঞ্চের অন্যতম বিচারক। তাঁর সঙ্গে ছিলেন একজন বিচারক ও এক কৌঁসুলি। কলকাতার লিগ্যাল এইডের উদ্যোগে হওয়া লোক আদালতে বসেছিল এরকম ৪২টি বেঞ্চ। সরকারি রাজস্ব আদায় হয় প্রায় ৬১ কোটি টাকা। এই ৪২ বেঞ্চের মধ্যে অন্যতম একটি প্রতিমাদেবীদের। 


    সেই কবে বাসের স্টিয়ারিং ধরেছিলেন। সংসার চালাতে সেটিই ধরে রয়েছেন। নিমতা‑হাওড়া রুটে মিনিবাস চালান প্রতিমাদেবী। শনিবার তাঁর অন্য ভূমিকা। সেদিন তাঁর অন্য মুড। হাজার হাজার মামলার নথির মধ্যে দিনভর ডুবে। তাঁর বেঞ্চে উঠেছিল মোটর দুর্ঘটনা, ট্রাফিক আইনভঙ্গ, ব্যাঙ্ক লোন, ইলেকট্রিক বিল সংক্রান্ত অভিযোগ, চেক বাউন্স সহ একাধিক ফৌজদারি মামলা। ঠান্ডা মাথায় প্রতিটি মামলার বিষয় বোঝার চেষ্টা করেন এক দিনের বিচারক প্রতিমাদেবী। সমস্যা হলে বেঞ্চে থাকা বিচারক‑আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করেন। বোঝেন দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির কৌশল। 


    ‘কেমন লাগল?’ উত্তরে এক দিনের বিচারক বলেন, ‘আমার এখনও ঘোর কাটেনি। ভাবতেই পারছি না মহামান্য বিচারকের সঙ্গে বসে বিচারকেরই ভূমিকা পালন করছি।’ কলকাতা নগর দেওয়ানি আদালতের মুখ্য বিচারক ও কলকাতা লিগ্যাল এইডের চেয়ারম্যান জয়শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়, বিচারক মৌ ঘটক মজুমদার সহ একাধিক প্রবীণ আইনজীবী সম্মান দিয়েছেন বলে জানালেন। বললেন, ‘প্রতিদিন পান থেকে চুন খসলে যাত্রীরা গালমন্দ করেন। এদিন শুধুই সম্মান পেলাম। অন্যদিন রাস্তায় পুলিস বাস থামালে মন কূ ডাকে। আজ তো পুলিস শুধুই স্যালুট করছিল। একটু লজ্জা লজ্জাও করছিল, বুঝলেন।’ জীবনের অন্যতম সেরা দিন তাঁর আজ। এটিই হয়ত  ছাপোষা-মধ্যবিত্ত এক গৃহবধূ-বাসচালকের জীবনের ‘গ্লোডেন ডে’।
  • Link to this news (বর্তমান)