• শ্বশুরবাড়ির বাধা পেরিয়ে স্বনির্ভর গাজোলের বধূ, শিল্পমেলায় বাঁশের সামগ্রী বিক্রি করে ছেলেকে ডাক্তার বানানোর স্বপ্ন দুর্গার
    বর্তমান | ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
  • সঞ্জিত সেনগুপ্ত, শিলিগুড়ি: ছেলের বউ হাতের কাজ করবে, বাইরে ঘুরে ঘুরে জিনিস বিক্রি করবে তাতে আপত্তি ছিল শ্বশুরের। গোলা ভরা ধান ঝাড়াই মারাই, সেদ্ধ করা, শুকনোর কাজ তাহলে করবে টা কে!  তাই কষ্ট করে শেখা হাতের কাজ বিয়ের পর বন্ধ রাখতে হয়েছিল। শ্বশুরের নির্দেশ নাকি, শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন পূরণ, কোনটা বেছে নেবেন  তা নিয়ে মালদহের গাজোলের সরকার পাড়ার দুর্গা মণ্ডলকে বিয়ের প্রথম তিনবছর নিজের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে। তিন বছর বাদে নিজের স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে স্বামীকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি ছাড়েন। ওঠেন ভাড়া বাড়িতে। শুরু হয়  দুর্গার অন্য লড়াই।  


    স্বামী দর্জির কাজ করতেন। সামান্য উপার্জন। ঠিকমতো সংসার চলে না।  তবুও ঝুঁকি নিতে দ্বিধা করেননি। সাহস ও আত্মপ্রত্যয়কে পুঁজি করে দুর্গাদেবী আজ শুধু প্রতিষ্ঠিতই নন, একজন জনপ্রিয় হস্তশিল্পীও বটে। 


    এই কাজ করে সংসার দাঁড় করিয়েছেন। গ্রামের ২৫ ঘরকে  বাঁশ দিয়ে হাতের কাজ বানানো শিখিয়েছেন। নিজের কারখানায় দশজনকে কাজে রেখেছেন। এখানেই শেষ নয়। একমাত্র পুত্রসন্তানকে ডাক্তার তৈরির স্বপ্নপূরণের দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছেন তিনি। 


    শিলিগুড়ির কাওয়াখালি বিশ্ব বাংলা শিল্পীহাটে উত্তরবঙ্গ হস্তশিল্প মেলায় ঢুকে  বাঁদিকে ঘুড়ে  প্রথম গলিতে নিজের সামগ্রী নিয়ে বসেছেন দুর্গা মণ্ডল। বাঁশ দিয়ে ঘর সাজানোর নানা জিনিস তৈরি করেন তিনি। নিখুঁত কাজ। এক দর্শনেই চোখ আটকে যায়। তাই তাঁর স্টলের সামনে ক্রেতার ভিড় লেগেই রয়েছে।


    দুর্গাদেবী বলেন, বিয়ের আগে রাজ্য সরকারের দেওয়া প্রশিক্ষণে এই কাজ শিখেছিলাম। শ্বশুরবাড়িতে অনেক স্বপ্ন নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু শ্বশুরমশাইয়ের আপত্তি ছিল। তিনি চাননি আমি এই কাজ করি। তাই তিন বছর হস্তশিল্প থেকে দূরে ছিলাম। একদিন সিদ্ধান্ত নিলাম, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। শ্বশুরবাড়ি  জমি, ধান আমার জন্য নয়। তাই বিয়ের তিন বছরের মাথায় স্বামীকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি ছেড়েছিলাম। ধীরে ধীরে কাজ শুরু করে স্থানীয় বাজার ধরতে শুরু করি। ভালোই সাড়া মিলতে থাকে। গ্রামের ২৫ ঘরকে এই কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁদেরও এই কাজে যুক্ত করি।  


    কিন্তু একটা সময় হতাশ হয়ে পড়েছিলেন দুর্গাদেবী। এই সামগ্রীর বিক্রির বাজার কোথায়! এই সমস্যারও সমাধান হয়। এজন্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি কৃতজ্ঞ তিনি। দুর্গাদেবী বলেন, তাঁর  উদ্যোগে হস্তশিল্পীদের প্রসার ও প্রতিষ্ঠার জন্য রাজ্যজুড়ে মেলা শুরু হয়। সেই মেলায় ঘুরতে ঘুরতেই নিজের স্বপ্ন পূরণের দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছি। আমাকে দেখে গ্রামের ঘরে ঘরে সকলেই হাতের কাজ করছে। আমার স্বামীও এই কাজে হাত মিলিয়েছেন। দর্জির কাজ কবে ছেড়ে তিনিও আজ একজন হস্তশিল্পী। এখানেই আমার আনন্দ। আমার শেষ স্বপ্নপূরণ হবে যেদিন আমার একমাত্র ছেলে ডাক্তারিতে পড়ার সুযোগ পাবে। ওকে ডাক্তারি পড়ানোর জন্য জয়েন্টের প্রস্তুতি নিতে রাজস্থানের কোটায় পাঠিয়েছি। বছরে দু’লক্ষ টাকা করে দিতে হয়। মেলায় ঘুরে ঘুরে তাঁরই খরচ জোগাচ্ছি। -নিজস্ব চিত্র।
  • Link to this news (বর্তমান)