• নদী খুঁড়ে দেদার লুট চলছে বালি, দেখেও দেখছে না প্রশাসন
    এই সময় | ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
  • বাসুদেব ভট্টাচার্য, ময়নাগুড়ি

    তখনও ভোরের আলো ঠিক মতো ফোটেনি। গোটা গ্রাম ঘুমিয়ে কাদা। আচমকা ট্র্যাক্টরের গর্জন শুনে ধড়মড়িয়ে উঠে লোকজন দেখলেন, ট্র্যাক্টরের ট্রলি থেকে নদীতে ঝাঁপ দিলো জনাকয়েক যুবক। নদীতে তেমন জল নেই। সেই হাঁটুজলেই ঝপাঝপ পড়তে শুরু করল কোদাল আর বেলচার কোপ।

    ময়নাগুড়িতে এ দৃশ্য চোখ-সওয়া। প্রথম দিকে প্রতিবাদ করেছিলেন গ্রামবাসীদের কেউ কেউ। ‘হুমকি’র বহরে পিছিয়ে এসেছেন তাঁরা। এখন নদীর বুক থেকে বালি লুটের দৃশ্য দেখেও মুখ ফিরিয়ে নেন তাঁরা। অভিযোগ, পুলিশ-প্রশাসন সব জানে। কিন্তু কোনও অজ্ঞাত কারণে কেউই এ ব্যাপারে বিশেষ রা কাড়েন না।

    সম্প্রতি বালি, কয়লা পাচার ও তোলাবাজি নিয়ে নবান্নে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, কোনও রাজনৈতিক রং বিচার না-করে পদক্ষেপ করতে হবে। ময়নাগুড়ির বাসিন্দাদের একাংশের কটাক্ষ, ‘মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ বোধহয় এখনও আমাদের প্রশাসনের কানে পৌঁছয়নি।’

    দোমহনীর বাগজান, নেওড়া, শৌলমারি-সহ বিভিন্ন নদী থেকে দেদার চলছে বালি পাচার। রাজস্বের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এলাকার বাসিন্দারাও। তাঁদের অভিযোগ, ট্রলিবোঝাই বালি নিয়ে প্রতিদিন ছুটছে ৫০-৬০টি ট্র্যাক্টর। সঙ্গে রয়েছে পিক-আপ ভ্যান। ফলে গ্রামের রাস্তার ক্ষতি হচ্ছে। বেপরোয়া ভাবে বালি তোলার ফলে নদীর পাড় ভাঙছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নদী লাগোয়া চাষ-আবাদের জমি, চা বাগান।

    কিছুদিন আগে বালি লুট নিয়ে সরব হয়েছিলেন বাগজান নদীপাড়ের লোকজন। অভিযোগ, প্রতিবাদ করতেই তাঁদের বালি মাফিয়াদের হুমকির মুখে পড়তে হয়। খবর পেয়ে ময়নাগুড়ি থানার পুলিশ একটি ট্র্যাক্টর আটক করে। চম্পট দেয় বালি কারবারিরা। ব্যস, ওই পর্যন্তই! স্থানীয় বাসিন্দা জগদীশচন্দ্র রায়ের অভিযোগ, বিষয়টি নিয়ে তাঁরা বহুবার ময়নাগুড়ি থানা, ভূমি ও ভূমি সংস্কার দপ্তরের আধিকারিক এবং বিডিওকে লিখিত অভিযোগ করেছেন। সকলেই পদক্ষেপ করার আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু কোনও সুরাহা হয়নি।

    জগদীশের দাবি, ‘বিএলএলআরও দপ্তরের আধিকারিকেরা আমাদের জানান, তাঁরা সকাল ১১টায় অফিসে আসেন। তারপরে তাঁরা ঘটনাস্থলে যেতে পারবেন। কিন্তু বালি মাফিয়ারা তো সাতসকালেই তাদের কাজ সেরে ফেলে!’ ময়নাগুড়ির ভূমি ও ভূমি সংস্কার দপ্তরের আধিকারিক দেবযানী মৈত্র বলেন, ‘কিছুদিন আগে একটি অভিযোগ এসেছিল। সেই সময়ে পদক্ষেপ করে বালি তোলা বন্ধ করা হয়েছিল। বর্তমানে পরিস্থিতি কেমন তা খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

    ময়নাগুড়ির বিডিও প্রসেনজিৎ কুণ্ডুর দাবি, ‘লিখিত অভিযোগ পেলে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নেব। সেই সঙ্গে বিএলএলআরও-কে বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেব।’ ময়নাগুড়ির নদীপাড়ের বাসিন্দাদের অভিযোগ, ‘দীর্ঘদিন থেকে বিভিন্ন দপ্তরের এমন টানাপড়েনই চলছে। আসল সমস্যার কোনও সমাধান হচ্ছে না। দিনের পর দিন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি আমরা। প্রতিবাদ করতে গেলে মাফিয়াদের হুমকির মুখে পড়ি। একই বিষয় নিয়ে ঠিক কতবার অভিযোগ করলে প্রশাসনের টনক নড়বে, বলুন তো?’

    ময়নাগুড়ি কলেজের ভূগোলের অধ্যাপক তথা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ড. মধুসূদন কর্মকারের কথায়, ‘অবৈধ ভাবে বালি তুললে নদীর যে প্রোটেক্টিভ কভার সেটা নষ্ট হয়ে যায়। নদী পাড় ভেঙে লাগোয়া এলাকা গ্রাস করতে থাকে। নষ্ট হয় বাস্তুতন্ত্র। এ ভাবে নিয়ম না-মেনে বালি তুললে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। সরকারি রাজস্বের ক্ষতি তো হচ্ছেই, সামগ্রিক ভাবে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশও।’

  • Link to this news (এই সময়)