সব্যসাচী মজুমদার, মালবাজার
এই শীতের মরশুমেও গাছপালা এতটুকু সবুজের আভা হারায়নি। চারদিকের নিস্তব্ধতা এতটাই যে, জোরে শব্দ করলে তা পাহাড়ে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসছে। একঝাঁক টিয়া পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে উড়ে গেল। বুধবার শীতের পড়ন্ত বিকেলে এভাবেই কালিম্পং জেলার সামসিংয়ের পোকরিতে উদ্বোধন হলো উত্তরের প্রকৃতিপ্রেমী সংস্থা ‘ন্যাফ’–এর ৩৩তম প্রকৃতি পাঠের আসর।
এই পোকরির শিবির মাঠে উপস্থিত হয়েছিল বিভিন্ন রাজ্যের ১২০ জন বিশেষ ভাবে সক্ষম ছাত্রছাত্রী। সুমন টাইটলার যেমন এসেছে রাজস্থান থেকে। তার সঙ্গে সঙ্গী হয়েছে একঝাঁক ছেলেমেয়ে। আবার নকশালবাড়ি থেকে এসেছে অনির্বাণ সাহা, তনবির শীল। ওরা কেউ জন্মান্ধ, কেউ বধির কেউ আবার অটিস্টিক এবং সেরিব্রাল পালসি।
ন্যাফের অনিমেষ বসু, প্রদীপ নাগদের আমন্ত্রণে এই শিবিরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করতে উপস্থিত ছিলেন পদ্মশ্রী প্রাপক হাতি বিশেষজ্ঞ পার্বতী বড়ুয়া। সঙ্গে ছিলেন উত্তরবঙ্গের বন্যপ্রান বিভাগের মুখ্য বনপাল ভাস্কর জেভি, ফরেস্ট ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের জেনারেল ম্যানেজার কুমার বিমল, চা শিল্পপতি সুরজিৎ পাল চৌধুরী প্রমুখ। পার্বতী বলেন, ‘এ জাতীয় প্রকৃতি পাঠ শিবির শিশু বয়স থেকেই মানুষের মধ্যে প্রকৃতি প্রেম তৈরি করে, মানুষ–প্রকৃতির সম্পর্ক দৃঢ় হয়।’ তাঁর কথার যথার্থতার প্রমাণ মেলে প্রিয়াংকা নাথের কথায়। সে বলে, ‘আমি তো চোখে দেখতে পাই না, কিন্তু এটা যে খুব সুন্দর জায়গা তা এসেই অনুভব করছি।’
ন্যাফের কো-অর্ডিনেটর অনিমেষ বসু জানান, শিবিরে যোগ দেওয়া ছেলেমেয়েদের শারীরিক অসুবিধার কথা বিচার করে প্রকৃতি পাঠের আসর ১০টি শিবিরে ভাগ করা হয়েছে। যাদের চলার ক্ষেত্রে অসুবিধা রয়েছে, তাদের বিভাগের নাম দেওয়া হয়েছে সব থেকে দ্রুততম প্রাণী চিতার নামে। আবার যাদের কথা বলার সমস্যা রয়েছে, তাদের দলের নাম সব থেকে সুমিষ্ট স্বরের প্রাণী কোকিলের নামে রাখা হয়েছে। স্পর্শ, ঘ্রাণ এবং শ্রবণের উপর জোর দিয়ে এক–একটি শিবিরে প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় ভাবে মেলামেশা করানো হবে।
এক প্রশিক্ষক জানান, ওদের পাহাড়ি ঝোরার কাছে একবেলা বসিয়ে রাখা হবে। ওরা শব্দ শুনবে, ঠান্ডা জলে পা ভেজাবে, যারা একটু বড় তাদের সেই নদী পেরিয়ে যাওয়ার কৌশল শেখানো হবে। একই ভাবে বড় বড় গাছের কাছেও যাবে ওরা, সেখানে গাছকে কেউ জড়িয়ে ধরবে, কেউ আবার পাতার স্পর্শ নেবে, ফুলের ঘ্রাণ নেবে। এভাবেই প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হবে।
তবে শুধু কি এভাবেই একেক দিন একেক জায়গায় ঘোরাঘুরি করে শখ পরিপূর্ণ করা? তা নয় মোটেই। বাবা-মায়ের কাছ থেকে বেরিয়ে এসে জঙ্গলের মাঝে কয়েকজন অচেনা সমবয়সি ছেলে–মেয়েদের সঙ্গে থাকা, রাত্রিবাস, নিজের হাতে খাওয়া, নিজেই খাওয়ার পর থালা ধুয়ে নেওয়া। এর কি কোনও গুরুত্ব নেই? অবশ্যই রয়েছে। এভাবে সবার সঙ্গে থাকা নিজের কাজ নিজে করার মাধ্যমে জীবনের প্রতিবন্ধকতাকে জয় করার কৌশলও রপ্ত করে ছাত্রছাত্রীরা। অনিমেষ বলেন, ‘প্রশিক্ষক গাইড মিলিয়ে আড়াইশো জন এই শিবিরে অংশ নিয়েছে। শিবির চলবে ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত।’ এই শিবির শেষ হলেই ২৫ ডিসেম্বর থেকে স্বাভাবিক ছেলেমেয়েদের নিয়ে আরেকটি পূর্ণাঙ্গ ক্যাম্প এ খানেই শুরু হবে।