এই সময়, মেদিনীপুর: ‘বিশ্ব দেখবে বিদ্যালয়ে’। স্কুলে বসে দেখা যাবে গোটা বিশ্বকে! খুদে পড়ুয়ারা পঠনপাঠনের পাশাপাশি জানতে পারবে দুনিয়া সম্পর্কে। কচিকাচাদের জন্য স্কুলের দেওয়ালে রয়েছে নানা রকমের ফুল, পশু-পাখি, জীবজন্তুর আঁকিবুকি। ক্লাসরুমগুলোর মধ্যে রয়েছে রঙিন বেলুন, সান্তা ক্লস ও অন্যান্য মজার চরিত্র। পড়াশোনার জন্য বসানো হয়েছে স্মার্ট টিভিও। ভাঙাচোরা নয়, ছোটখাটো স্মার্ট ক্লাসই বলা যায়। এই ছবি শহর কলকাতার কোনও নামী বেসরকারি স্কুল নয়। দেখা গিয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরা ব্লকের প্রত্যন্ত খানামোহন গ্রাম পঞ্চায়েতের কুলডিহা ক্ষুদ্রমণি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
প্রত্যন্ত এলাকার স্কুলের সাতটি রুম। যার মধ্যে ৬টি স্মার্ট ক্লাসরুম। প্রতি কক্ষে রয়েছে বড় স্মার্ট টিভি, ইন্টারনেটের ব্যবস্থা, ল্যাপটপ, কম্পিউটার। সিসিটিভি ক্যামেরায় মোড়া স্কুল চত্বর। মেঝেতে মার্বেল পাথর ও টাইলস বসানো। শৌচাগারগুলি তেমনই ঝকঝকে। করোনায় থমকে গিয়েছিল কিচেন গার্ডেন, মাশরুম চাষ, সেমি বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ। আবার জোরকদমে শুরু হয়েছে জৈবসার (ভার্মিকম্পোস্টিং) তৈরি থেকে সবজি ও মাছ চাষের প্রস্তুতি। পড়ুয়াদের স্কুলের প্রতি আকর্ষণ বাড়াতেই এমন উদ্যোগ জানিয়েছে স্কুল কতৃপক্ষ।
কিন্তু সরকারি প্রাইমারি স্কুল এত টাকা পেল কোথা থেকে? প্রশ্ন করতেই স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কৃষ্ণেন্দু হাইত মজা করে বলেন, ‘গৌরী সেন’! কথায় বলে না টাকা দেবে ‘গৌরী সেন’! ইচ্ছে থাকলে টাকার অভাব হয় না। বিভিন্ন জায়গায় আবেদন করেছি। অনেকে সাহায্য করেছেন। কেউ দেননি, উল্টে দুটো কথা শুনিয়েছেন। তাতে অবশ্য থেমে থাকিনি। এলাকায় এমন অনেক গৌরী সেন আছেন, যারা স্কুল সাজাতে সাহায্য করেছেন। বাকি নিজেরাই দিয়েছি।’
ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জুড়লেন, ‘আগে প্রায় সাড়ে তিন বছর কেন্দ্রীয় সরকারের পোস্টাল ডিপার্টমেন্টে চাকরি করেছি। চাকরি ছেড়ে ২০০৭–এর জুলাইয়ে এই স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিই। একটা অন্য ধরনের স্কুল তৈরির স্বপ্ন দেখতাম। সেই চেষ্টাই চলছে। স্কুলে অন্যান্য শিক্ষক-শিক্ষিকা, অভিভাবক, গ্রামের মানুষজন সকলের সহযোগিতায় এগিয়ে চলেছি।’
ডেবরা বাজার থেকে উত্তরে চার কিলোমিটার যাওয়ার পর আবার বাঁ-দিকে দেড় কিলোমিটার গেলেই প্রত্যন্ত গ্রাম কুল্ডিহা। গ্রামের রাস্তার পাশে বিশাল এলাকা জুড়ে কুলডিহা ক্ষুদ্রমণি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ১৯৬৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর জনাকয়েক শিশুকে নিয়ে বাঁশ-পাতার চালাঘরে শুরু হয় বিদ্যালয়ের পথ চলা। আজ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে দোতলা পাকা বাড়ি। কিছুটা কংক্রিটের ঢালাই, কিছুটা টিনের ছাউনি দেওয়া।
বিদ্যালয়ের প্রাচীরের দেওয়ালে নান মনীষীর ছবি। সঙ্গে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে আস্ত সহজপাঠ বইটিকে। যা দেখে সহজপাঠের অর্ধেক পড়া করে নিতে পারবে শিশুরা। স্কুলের পরিকাঠামো বদলের সঙ্গে সঙ্গে ‘স্মার্ট’ হয়েছে ক্লাসরুমও। শ্রেণিকক্ষে টিভি-র সুইচ চালু করে মুখের সামনে রিমোট ধরে যা বলবে তাই ভেসে উঠবে স্মার্ট টিভির স্ক্রিনে। স্নিগ্ধা প্রামানিক নামে এক ছাত্রী মুখের সামনে রিমোট নিয়ে বলে উঠল, ‘হাণ্ড্রেড ফ্রুটস নেম ইন বেঙ্গলি অ্যান্ড ইংলিশ।’
বেরিয়ে এল রকমারি ফল। কার্টুনের মাধ্যমে কোনটি কী ফল। কোনও ফলের ইংরেজি নাম কী। ফলটি দেখতে কেমন ইত্যাদি বিষয়গুলি। ক্লাসে বসে অন্যান্য শিশুরা মনোযোগ দিয়ে দেখছে। প্রশ্নোত্তর পর্ব চালাচ্ছেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা। এভাবেই পাঠদান হচ্ছে ক্ষুদ্রমণি বিদ্যালয়ে। বর্তমানে স্কুলের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ১০৭ জন। শিক্ষক-শিক্ষিকা ৫ জন (একজন পার্শ্ব-শিক্ষিকা সহ)।
প্রত্যন্ত গ্রামে স্মার্ট স্কুল সম্পর্কে ডেবরা চক্রের অবর বিদ্যালয় পরিদর্শক স্বাতী দে বলেন, ‘স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করে অর্থ এনেছেন। এ ক্ষেত্রে সরকারি ফান্ড নেই। ক্লাসরুমগুলি সুন্দর ভাবে সাজিয়ে স্মার্ট ক্লাসের মতো করা হয়েছে।’ গ্রামের বাসিন্দা গোপাল চন্দ্র মান্না, মদন মান্না, খুকু ভট্টাচার্যরা বলেন, ‘প্রত্যন্ত গ্রামে এমন স্মার্ট স্কুলের উদ্যোগে অভাবনীয়। সবই কৃষ্ণেন্দু স্যারের উদ্যোগ। স্কুলের জন্য তিনি ও অন্যান্য শিক্ষক-শিক্ষিকারা অনেক কিছু করছেন। ছেলেমেয়েরা স্কুল বন্ধ করতেই চায় না।’
আর কাগজের টিএলএম দেখিয়ে পঠনপাঠান নয়। একেবারে স্মার্ট টিভিতে সমস্ত টিএলএম। ভীষণ খুশি অনন্যা জানা, সঞ্জীব পাল, স্নিগ্ধা প্রামানিক, তৃষিতা দাস, অনিক মাইতিরা। এই খুদেদের কথায়, ‘স্কুলেই অধিকাংশ পড়া হয়ে যায়। স্কুল বন্ধ থাকলে মন খারাপ করে।’