সঞ্জয় চক্রবর্তী, শিলিগুড়ি
খিদের জ্বালা বড় জ্বালা! আর সেই যন্ত্রণা সহ্য করতে না-পেরে কিশোরীবেলায় তিনি ঢুকে পড়েছিলেন চোরাচালানকারীদের দলে। তাঁর মতো আরও শ’দেড়েক মেয়েকে একজোট করে তৈরি করেছিলেন বিরাট গ্যাং। যে গ্যাং-এর কর্মকাণ্ডে ঘুম ছুটেছিল এসএসবি-র। আবার সেই এসএসবি-র এক জওয়ানের কথায় একদিন সব ছেড়ে নেমে পড়েন সমাজসেবায়।
অভুক্ত মহিলাদের বাড়িতে নিয়ে এসে খাবারের ব্যবস্থা করেন তিনি। তাঁদের সেবা করেন। বাড়িতে ছ’জন বয়স্ক মহিলাকে আশ্রয় দিয়েছেন। যাঁদের সবাইকেই বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে আপনজনেরা। রাস্তায় পড়ে থেকে তাঁদের কারও মাথায় জট হয়েছিল। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। ওই মহিলাদের সুস্থ করে তুলেছেন তিনি। নিজের বাড়িতে রেখে তাঁদের তিন বেলা খাবার জোটান। অসুখ-বিসুখেও তিনিই ভরসা।
শিলিগুড়ির আশরফিনগরের বাসিন্দা পূজা মোক্তারের জীবন সিনেমার চেয়ে কম কিছু নয়। পূজা অবশ্য এতশত ভাবেন না। তিনি বলেন, ‘যে খিদের জ্বালায় শিলিগুড়ি থেকে ভারত-নেপাল সীমান্তের পানিট্যাঙ্কিতে চলে গিয়েছিলাম চোরাচালানকারীদের দলে, সেই খিদের জ্বালায় কাউকে মরতে দেখলে নিজের মাথা ঠিক রাখতে পারি না। তখন দৌড়ে চলে যাই তাঁদের পাশে। এটুকু না-পারলে আর কিসের মানুষ!’
পূজার আসল বাড়ি শিলিগুড়ির শক্তিগড়ে। তাঁর এক দাদা এবং দুই বোন। বাবা সুভাষচন্দ্র পাইন ছিলেন ট্রাক ট্রান্সপোর্টের মালিক। বছরভর বাড়ি ভর্তি হয়ে থাকত আত্মীয়স্বজনের ভিড়ে। তেরো বছর বয়সে বাবা মারা যাওয়ার পরে পূজার জীবনে অন্ধকার নেমে এলো। মা গীতারানি ছোট মেয়েকে নিয়ে চলে গেলেন তারাপীঠে। দাদাও বোনের থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলেন। প্রতিবেশীরা খাবার দিলেই পেট ভরতো। না-হলে ভরসা জল। খিদে সহ্য করতে না-পেরে একদিন পূজা চলে গেলেন ভারত-নেপাল সীমান্তের পানিট্যাঙ্কি।
সেখানেই পরিচয় হলো এক আদিবাসী মহিলার সঙ্গে। ক্ষুধার্ত পূজাকে তিনিই চোরাচালানের পথে নামান। তখন নেপাল থেকে চোরাপথে সুপারি আসত শিলিগুড়ির বাজারে। আদিবাসী মহিলা মারা গেলে পূজাই হয়ে ওঠেন ওই চোরাচালানের মাথা। দেড়শো মহিলা তাঁর সঙ্গে কাজ করতেন। কাজের ফাঁকে পূজা খোঁজ নিতেন, কার মেয়ের টাকার অভাবে বিয়ে হচ্ছে না। কার অনাথ বাচ্চা রাস্তায় পড়ে রয়েছে। তখনও পূজাই ছিলেন বাকি মেয়েদের ভরসা। এসএসবি-র জওয়ান রাজবীর সিংয়ের কথায় সেই পূজার জীবনই আচমকা অন্য খাতে বইতে শুরু করল।
পূজার কথায়, ‘এসএসবি-র ওই জওয়ান বললেন— মা তুই এই ব্যবসা করিস না। ছেড়ে দে। এটা ভালো না! আমারও ততদিনে মনে হচ্ছিল, পুলিশের তাড়া খেয়ে এমন ব্যবসা করছি কেন। তাই ছেড়ে দিলাম।’ তবে চোরাচালান ছেড়ে দিলেও পানিট্যাঙ্কি ছাড়া হলো না পূজার। তখন শিলিগুড়ি থেকে নেপালে নানা ধরনের কাপড় পাঠানোর ব্যবসা করতেন। শেষ পর্যন্ত মোক্তার আলম নামে এক ব্যক্তিকে বিয়ে করে তিনি চলে আসেন আশরফিনগরে। ইস্কন মন্দির রোডে নিজের একটা কাপড়ের দোকান দিলেন। সেই দোকান এখন নিজের মেয়েকে দিয়ে দিয়েছেন। স্বামীকে নিয়ে ওই ব্যবসা চালান মেয়ে। ছেলে কলেজে পড়ে।
এসএসবি-র ওই জওয়ান বললেন— মা তুই এই ব্যবসা করিস না। ছেড়ে দে। এটা ভালো না! ওই কথা শোনার পরে ব্যবসা ছেড়ে দিলাম।