ডিসেম্বর শেষ হয়ে নতুন বছর দোরগোড়ায় কড়া নাড়ছে। কিন্তু রবীন্দ্র সরোবরে দেখা নেই পরিযায়ী পাখির! তা নিয়ে উদ্বেগে পক্ষীপ্রেমীরা।
ফি–বছর শীতের শুরুতেই সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া, তিব্বত, চিন প্রভৃতি দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে দক্ষিণ কলকাতার রবীন্দ্র সরোবরে ভিড় জমাতে শুরু করে ভিনদেশি পরিযায়ীরা। রবীন্দ্র সরোবরের বুকে যে সব ছোট ছোট সবুজ ভূখণ্ড রয়েছে সেখানেই তারা ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে বাচ্চা হয়। কয়েক মাস এখানে কাটিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে আবার স্বদেশে ফিরে যায় পাখির দল। দূর–দূরান্ত থেকে আসা পরিযায়ী পাখিদের দেখতে এই সময়ে বহু মানুষ রবীন্দ্র সরোবরে আসেন। পরিযায়ীদের ক্যামেরাবন্দি করেন। কিন্তু এ বছর তাদের দেখা না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরতে হচ্ছে পক্ষীপ্রেমীদের।
কী এমন ঘটল, যে রবীন্দ্র সরোবর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল পরিযায়ীরা? পরিবেশকর্মী সুমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, কলকাতায় শীত পড়ার আগে গত অক্টোবরে পরিযায়ী পাখিদের একটি দল সরোবরে রেকি করতে এসেছিল। সাধারণত এই দলটি ফিরে যাওয়ার পর নভেম্বরের শুরু থেকেই ধাপে ধাপে ভিনদেশি পরিযায়ীরা আসতে শুরু করে। কিন্তু এ বার প্রথম দলটি রেকি করে ফিরে গেলেও তারপর আর কেউ আসেনি।
সুমিতার অভিযোগ, ‘অক্টোবরের পর থেকেই রবীন্দ্র সরোবরের নির্মাণ শুরু হয়েছে। তার জন্য পে–লোডারের মতো ভারী যন্ত্রপাতির ব্যবহার হচ্ছে। রাতে বড় বড় আলো জ্বালিয়ে রাখা হচ্ছে। আশপাশে যে সব ক্লাব রয়েছে সেখানেও রাত পর্যন্ত সাউন্ড বক্স বাজিয়ে অনুষ্ঠান চলছে। সৌন্দর্যায়নের নামে রবীন্দ্র সরোবরে প্রচুর ডেকোরেটিভ আলো লাগানো হয়েছে। খাবার, প্লাস্টিক এবং আবর্জনা ফেলায় সরোবরের জলে দূষণ বাড়ছে।’ সুমিতার মতো অনেকেই মনে করছেন, সরবোরের শান্তির পরিবেশ নষ্ট হওয়ায় পরিযায়ীরা পাখিরা আসতে ভয় পাচ্ছে।
২০১৯ সালের সমীক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী, রবীন্দ্র সরবোরে সে বার ১০৭ প্রজাতির পাখির দেখা মিলেছিল। তার মধ্যে ৬৯টি আবাসিক পাখি। ১৪টি প্রজাতির পাখি স্থানীয় অভিবাসী। সে বছর মোট ২৩ ধরনের ভিনদেশি পরিযায়ী পাখির উপস্থিতি রেকর্ড করা হয়েছিল। ২০২১ সালে ১১৮টি, ২০২২ সালে ১১৬টি এবং ২০২৩ সালে ১১০টি প্রজাতির পাখির সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু এ বার একটিও পরিযায়ী পাখি আসেনি।
রবীন্দ্র সরোবরের প্রাতভ্রমণকারী কলকাতা পুরসভার প্রাক্তন আধিকারিক কল্যাণ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘অক্টোবর মাসে সরবোরে কিছু পরিযায়ী পাখি চোখে পড়েছিল। ভেবেছিলাম, শীত পড়লে হয়তো আরও পাখি ঢুকবে। আমি তো রোজ খোঁজ নিচ্ছি। এখনও কোনও পরিযায়ী পাখি ঢোকেনি। আদৌ আসবে কি না, সেটাও বুঝতে পারছি না।’
কেএমডিএ–র এক শীর্ষকর্তার ব্যাখ্যা, ‘বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে কলকাতার আবহাওয়া পাল্টে যাচ্ছে। ডিসেম্বরে যতটা ঠান্ডা পড়ার কথা ততটা এ বার পড়েনি। পরিযায়ী পাখি না আসার পিছনে মনে হয় এটাও একটা বড় কারণ। শুধু নির্মাণের জন্য পাখিরা আসছে না, এমনটা নয়।’ তিনি জানিয়েছেন, নিরাপত্তার কারণে সরোবরে বাড়তি লাইট দিতে হয়েছে। কারণ, বহু মানুষ এখানে হাঁটতে আসেন। ক্লাবগুলিকেও রাতে জোরে সাউন্ড বক্স বাজাতে নিষেধ করা হয়েছে।