রূপক মজুমদার, বর্ধমান
আবাস যোজনা প্রকল্পে উপভোক্তাদের তালিকায় কখনও নেতার নাম, কখনও এসেছে তাঁর স্ত্রী, আত্মীয় বা ঘনিষ্ঠদের নাম। সরকারি বাড়ি পাইয়ে দেওয়া নিয়ে সারা রাজ্যে এর আগে স্বজনপোষণ ও দুর্নীতির প্রচুর অভিযোগ উঠেছে শাসকদল তৃণমূলের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে পথেও নেমেছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। তবে এ বছর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে আবাস যোজনার রাজ্য সংস্করণ ‘বাংলার বাড়ি’ প্রকল্প ঘোষণার পর দেখা যাচ্ছে ভিন্ন ছবি। বিরোধী বিজেপি বা সিপিএমের সঙ্গে যুক্ত কর্মী–সমর্থকরাও এ বার পাচ্ছেন ‘বাংলার বাড়ি’।
বর্ধমান–১ ব্লকের রায়ান ১ পঞ্চায়েত এলাকা বাসিন্দা সৌমিত্র সাম সক্রিয় বিজেপি কর্মী। শুক্রবার তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, সামনে উড়ছে পদ্ম শিবিরের দলীয় পতাকা। বাংলার বাড়ি প্রকল্পে তাঁর স্ত্রীর নাম এসেছে। সৌমিত্র বলেন, ‘আগের বার আমাদের নাম আসেনি। তবে এ বার স্ত্রীর নাম উপভোক্তা–তালিকায় এসেছে। আমি কোথাও কোনও তদ্বির করিনি। নিয়ম মেনে অন্যদের মতোই আবেদন জানিয়েছিলাম। এ বার যে স্বচ্ছ ভাবে তালিকা তৈরি হয়েছে এটাই তার প্রমাণ।’
তবে সৌমিত্রর অভিযোগ, ‘বাড়ির জন্য কেউ কোনও টাকা দাবি করেনি। কিন্তু ইট-বালি-পাথর জোগাড় করতে গিয়ে বুঝেছি দাম প্রচুর বেড়েছে। এখন এ ভাবে ঘুরপথে শাসকদলের নেতারা কোনও সুযোগ নিচ্ছেন কি না, বলতে পারব না।’
খণ্ডঘোষ ব্লকের বিজেপি ও সিপিএমের প্রভাব রয়েছে শশঙ্গা পঞ্চায়েত এলাকায়। এ বারও লোকসভা নির্বাচনে সেখানে পিছিয়ে ছিল তৃণমূল। ওই এলাকার অনেক বাসিন্দা বাংলার বাড়ি প্রকল্পে ঘর পেয়েছে। ষাটোর্ধ্ব রাধারানি সাঁতরা বলেন, ‘আমি সিপিএম করি। এ বার ভোটের প্রচারেও হেঁটেছি। আমি ঘর পেয়েছি। কাউকে কোনও টাকা দিতে হয়নি।’
যদিও এলাকার সিপিএম নেতা বিনোদ ঘোষ বলেন, ‘আবাস যোজনা বা বাংলার বাড়ি যাই বলুন না কেন, সেখানে ৩৫ শতাংশ মানুষ যাঁরা ঘর পেয়েছেন তাঁরা সত্যিই যোগ্য। এখানে সিপিএম বা বিজেপি বলে আলাদা করে চিহ্নিত করার দরকার নেই। তবে বাকি ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ উপভোক্তাদের ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। আমরা বিডিও–কে সে কথা জানিয়েছি। লাভ হয়নি।’
খণ্ডঘোষ ব্লকের তৃণমূল সভাপতি অপার্থিব ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সমস্যা হলো, এরা (বিরোধীরা) ভালোটাকেও হজম করতে পারছে না। খণ্ডঘোষ ব্লকের প্রথম তালিকায় তিন হাজার ৭০০ জনের নাম এসেছে। উপভোক্তাদের অর্ধেকই বিরোধী দলের সঙ্গে যুক্ত। খোঁজ নিয়ে দেখুন।’
হাটগোবিন্দপুরের বাসিন্দা সন্ধ্যারানি মাঝি। ত্রিপল দিয়ে ঢাকা অর্ধেক ভাঙা বাড়িতে কোনও ভাবে স্বামী আর দুই ছেলেকে নিয়ে থাকেন। পাড়ায় ঘুরে খেতের বেগুন বিক্রি করেন তিনি। স্বামী হিমঘরের শ্রমিক। সন্ধ্যারানি বলেন, ‘আর বেশি দিন এ ভাবে কষ্ট করতে হবে না। তালিকায় আমার নাম রয়েছে। এ বার বর্ষায় মাথার উপর ছাদ থাকবে ।’ তাঁর কথায়, ‘আগের বার অনেক ঘোরাঘুরি করেও আমাদের নাম আসেনি। আর এ বার কারও কাছে না গিয়ে পঞ্চায়েত অফিসে কাগজ জমা দেওয়ার পর দেখছি, নাম এসেছে।’
এ দিকে, প্রকল্পের কাজ যাতে আটকে না থাকে তার জন্য শনিবার ছুটির দিনেও বর্ধমানে খোলা থাকছে ট্রেজারি অফিসগুলো। বর্ধমান উত্তরের মহকুমাশাসক তীর্থঙ্কর বিশ্বাস বলেন, ‘ব্লক অফিস থেকে বিডিওরা যাতে বাংলার বাড়ি প্রকল্পের বিলের টাকা জমা করতে পারেন তার জন্য শনিবার ট্রেজারি অফিস খোলা থাকবে। শুক্রবার পর্যন্ত প্রায় ১৮ হাজার জনের টাকা দিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
প্রথম কিস্তির টাকা পাওয়া গেলেও উপভোক্তারা পড়েছেন অন্য সমস্যায়। গত কয়েকদিনের মধ্যে নির্মাণ সামগ্রীর দাম প্রচুর বেড়ে গিয়েছে। বর্ধমান-১ ব্লকের রায়ান ১ পঞ্চায়েতের বাসিন্দা জবা মাহাতো বলেন, ‘আমাদের এলাকায় চারজন নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবসা করেন। তাঁরাই জানালেন, সাতদিন আগেও ৯-১০ টাকায় বিক্রি হওয়া ইটের দাম এখন ১২ টাকা। স্টোনচিপ্সের দাম কুইন্টালে ৫০ থেকে ৭৫ টাকা বেড়ে গিয়েছে। যে বালির দাম প্রতি ট্র্যাক্টর সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকা ছিল, তার দর এখন সাড়ে চার হাজার টাকা।’
পূর্ব বর্ধমানের জেলাশাসক আয়েশা রানি এ বলেন, ‘নির্মাণ সামগ্রীর দাম আচমকা বেড়ে যাওয়ার খবর আমরা পেয়েছি। জেলা প্রশাসনের আধিকারিকরা ইতিমধ্যে এ নিয়ে আলোচনা করেছেন। নির্মাণ সামগ্রীর কোনওরকম কালোবাজারি হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অতিরিক্ত জেলাশাসককে (সাধারণ) বিষয়টি দেখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ জেলাশাসক আরও জানান, উপভোক্তাদের চূড়ান্ত তালিকা নিয়ে কারও যদি এখনও কোনও সন্দেহ থাকে নির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ দিয়ে অভিযোগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।