সাত বছরের নাবালিকাকে অপহরণের চেষ্টা। সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে ছিল পুলিশও। কথায় আছে, পুলিশ চাইলে কী না পারে। মালদহ জেলা পুলিশ, উত্তর দিনাজপুর পুলিশ ও সুন্দরবন পুলিশের যৌথ প্রচেষ্টা এবং বিহার পুলিশের সহযোগিতা সেটাই প্রমাণ করল শনিবার। এক থানার সঙ্গে অন্য থানার সমন্বয়ই ফিরিয়ে আনল মালদহের হরিশচন্দ্রপুরের সাত বছরের নাবালিকাকে, তাও কয়েক ঘণ্টার মধ্যে। এই উদ্ধারপর্বের প্রতি পরতে ছিল টান টান উত্তেজনা, রুদ্ধশ্বাস অভিযান।
শনিবার সকাল তখন প্রায় সাড়ে ১১টা। হরিশচন্দ্রপুর থানায় নাবালিকা অপহরণের খবর আসে। হরিশচন্দ্রপুর থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে প্রাথমিক তদন্ত করে। একটি সিসিটিভি ফুটেজ থেকে নম্বরপ্লেটহীন বাইকের খোঁজ পায় তারা।
শুধুমাত্র বাইকের মডেল, অপহরণকারীদের পোশাক, হেলমেটের রং ও নাবালিকার পরণের পোশাকের তথ্যকে সম্বল করে শুরু হয় খোঁজ। সিসিটিভির ফুটেজে পুলিশ নজর করে, ঠিক কোন ভঙ্গিতে নাবালিকাকে বাইকে বসানো হয়। নাবালিকার বাবার সঙ্গে কথা বলে পুলিশ বিশেষ কোনও তথ্য পাননি। তিনি জানান, তাঁর কোনও শত্রুও নেই।
এর পরই সিসিটিভি চেকিং টিম তৈরি করে মালদা জেলা পুলিশ। মালদা জেলা পুলিশের নজরদারি সংক্রান্ত একটি অ্যাপ আছে। সেখানে জেলার বিভিন্ন পয়েন্টের সিসিটিভি ম্যাপিং করা আছে। একটি সিসিটিভি ম্যাপিং টিম ও একটি সার্চ টিম তৈরি করা হয় তড়িঘড়ি।
শুরু হয় নাকা তল্লাশি। বিশেষ করে বিহার সীমানায় এই নাকা চলে। কারণ, পুলিশের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল, অপরাধীরা প্রথমেই রাজ্যের সীমানা পার করার চেষ্টা করে। বিহারের থানায় যোগাযোগ করা হয়, সঙ্গে প্রয়োজনীয় তথ্য দেয় মালদা পুলিশ। এই সবের মধ্যেই নাবালিকার বাবার কাছে অচেনা নম্বর থেকে একটি হুমকি মেসেজ আসে। পুলিশকে জানানোর ফল ভুগতে হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়।
যে নম্বর থেকে মেসেজটি আসে, তার টেকনিক্যাল ট্র্যাকিং করে জানা যায়, নম্বরটি ভুয়ো। কিন্তু সেই ভুয়ো নম্বরের সঙ্গে সুন্দরবনের একটি নম্বরের যোগ মেলে। সুন্দরবনের সেই নম্বরটি আবার নাবালিকার বাবার ব্যবসায়িক সূত্রে পরিচিত। বাবা পুলিশকে জানান, পাঁচ বছর আগে এক ব্যক্তির সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল। এখন কোনও যোগ নেই। তবে পুলিশ বিষয়টি হালকা ভাবে নেয়নি। সঙ্গে সঙ্গে এসপি সুন্দরবনের সঙ্গে যোগাযোগ করে। একই সঙ্গে আরও কিছু তথ্যের নিরিখে রায়গঞ্জ ও ইসলামপুরের এসপির সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।
দুপুর তখন প্রায় তিনটে। নাবালিকার বাবার মোবাইলে ফোন আসে। বাবার সঙ্গে মেয়ের কথা বলায় অপহরণকারীরা। মেয়েকে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে, তবে এর পর কী হবে তা নিয়েই হুমকি দিতে ফোন। যদিও নাবালিকার বাবা সাহস যোগান মেয়েকে। ভয় পেতে না করেন। শেষমেশ পুলিশের সিসিটিভি ম্যাপিং এবং ফোন ট্র্যাকিংয়েই উত্তর দিনাজপুরের করণদিঘি থানার টুঙ্গীদিঘির কাছে ধরা পড়ে ওই দুষ্কৃতীরা।
বিপদ এড়ানো যাবে না বুঝে নাবালিকাকে রাস্তায় ফেলে পালানোর চেষ্টা করে তারা। এ দিকে থানার কনস্টেবল থেকে বড় বাবু, সিভিক ভলান্টিয়ার থেকে ট্রাফিক পুলিশ, সকলেই ময়দানে। টান টান উত্তেজনা, অনবরত ফোন, ওয়াকিটকিতে কনট্যাক্ট। টুঙ্গীদিঘির কাছে এক ট্রাফিক পুলিশের নজরে আসে, এক নাবালিকাকে বাইক থেকে কারা রাস্তায় ফেলে পালাচ্ছে।
ধাওয়া করে এরপরই গ্রেপ্তার করা হয় দুই দুষ্কৃতীকে। ধৃতদের নাম ইজাজ আহমেদ ও মনসুর আলম। একজন ওষুধ ব্যবসায়ী, অন্যজন জমি জায়গার কারবারে যুক্ত। ধৃতদের হেফাজত থেকে উদ্ধার হয়েছে একটি পাইপগান। রবিবার তাদের মালদা জেলা আদালতে তোলা হবে।
শনিবার সাংবাদিক বৈঠক করে মালদহের পুলিশ সুপার প্রদীপকুমার যাদব জানান, খুব ভালো কোঅর্ডিনেশন হয়েছে। তাই এই সাফল্য। এসপির কথায়, ‘প্রথমত আমরা কোনও সাসপেক্ট পাইনি। আইডেন্টিফাই করার মতো জোরালো তথ্য ছিল না। এর জন্য একটু কঠিন ছিল এই লড়াইটা। সকলের মধ্যে সমন্বয় না থাকলে এই অভিযান করা যেতো না। প্রত্যেক পুলিশ কর্মীর ব্যক্তিগত উদ্যোগ ছাড়া এটা সম্ভব হতো না। কনস্টেবল থেকে অফিসার, সকলে হার্ট অ্যান্ড সোল কাজ করেছেন।’ মুক্তিপণ আদায়ের জন্যই শিশুকে অপহরণ করা হয়েছিল বলে, প্রাথমিক অনুমান জেলা পুলিশের। বাকিটা জেরায় উঠে আসবে বলেই জানান এসপি।