• রক্তদানের পুণ্য থেকে গরিবের হাসপাতাল, রূপকথা হুগলিতে
    এই সময় | ২২ ডিসেম্বর ২০২৪
  • রাজেন্দ্রনাথ বাগ

    সে দিনের তরুণরা এখন প্রৌঢ়। তবে উৎসাহ, উদ্যম দেখে বোঝে কার সাধ্য! ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোয় এতজন মিলে জীবনের যে অন্য মানে খোঁজা যায়—জাঙ্গিপাড়ায় না-এলে বোঝা যাবে না। পাড়ায় পাড়ায় ক্লাব কালচারের এপিটাফ লেখার এই আকালে হুগলির জাঙ্গিপাড়া থান্ডার ক্লাবের কর্মকাণ্ডে বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের যুক্ত হওয়াও অবাক করার মতো।

    পটলডাঙায় নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের টেনিদার ক্লাব ছিল ‘থান্ডার’। কলকাতা থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরের গঞ্জ জাঙ্গিপাড়ায় ১৯৭৬-এ পথচলা শুরু করা ক্লাবের নাম সেই অনুসরণেই। এলাকার সর্বপ্রিয় শিক্ষকের স্মৃতিতে ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজনের মধ্যে দিয়ে শুরু। এখন থান্ডার নিয়োজিত ফুটবল প্রশিক্ষণে, বিশেষত মেয়েদের জন্যে। এক সময়ে ডাবল উইকেট ক্রিকেট টুর্নামেন্ট, সাইকেলে দেশভ্রমণও ছিল ফি-বছরের কর্মসূচি।

    বিতর্কসভা, সেমিনার আয়োজন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও চলেছে। সময় যত গিয়েছে, থান্ডার কাঁধে তুলে নিয়েছে বৃহত্তর সামাজিক দায়িত্ব৷ ১৯৮৪-তে শুরু বছরে দু’বার রক্তদান শিবিরের (এক বার অবশ্যই গ্রীষ্মে)।

    করোনার সময়ে ১১ মাসে ৮টি শিবিরে রক্তদান করেছিলেন ৫৫৯ জন। বিনামূল্যে চোখের অপারেশন, স্বাস্থ্যশিবির, বর্ষায় বন্যাদুর্গত এলাকায় ত্রাণশিবিরের আয়োজনও চালিয়ে চলেছেন থান্ডারের সদস্যরা। প্রৌঢ়দের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়েছেন তরুণরা। সদস্যদের দাবি, যত যা কাজ চলছে, সবই এলাকার মানুষের বিপুল সমর্থন, সহযোগিতাতেই।

    পরিবহণের সমস্যায় ভোগা এলাকার গরিব মানুষের প্রয়োজনে ১৯৯৪-এ থান্ডার শুরু করে স্বল্পব্যয়ে অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা। করোনাকালে সেই অ্যাম্বুল্যান্স হয়ে উঠেছিল বিপন্ন মানুষের লাইফলাইন। ’৯৪-এ থান্ডারের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবার সূচনা করেছিলেন সুমন চট্টোপাধ্যায় (কবীর সুমন)। ২০১৩-য় নতুন অ্যাম্বুল্যান্সের উদ্বোধনে এসেছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। শতবর্ষ পেরোনো জাঙ্গিপাড়া ডিএন স্কুলের একদা শিক্ষক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মরণে এলাকাবাসীর জন্যে হাসপাতাল গড়ার ভাবনাটা উসকে দিয়ে যান তিনিই।

    জমি সংগ্রহ থেকে হাসপাতালের বাড়ি তোলার কাজে যুক্ত হয়েছেন এলাকার এবং বাইরের বহু মানুষ। বিভূতিভূষণ সেবাসদনের আউটডোরের উদ্বোধন হয় ২০১৯-এর মে মাসে প্রবীণ চিকিৎসক সুকুমার মুখোপাধ্যায় এবং অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অসীমকুমার রায়ের হাতে। চালু রয়েছে চক্ষু অস্ত্রোপচার এবং ডে-কেয়ার সেন্টার। প্রায় সাত দিনই চালু থাকে আউটডোর নানা এলাকা থেকে আসা সহৃদয় ডাক্তারবাবুদের সৌজন্যে।

    জাঙ্গিপাড়ার ৩৫ শতাংশ মানুষ তফসিলি জাতিভুক্ত। দারিদ্রও প্রভূত। করোনার সময়ে লকডাউনে স্কুল বন্ধের পরিস্থিতিতে এমন সব পরিবারের পড়ুয়াদের স্বার্থে থান্ডার চালু করেছিল অবৈতনিক কোচিং ক্লাস। তার দৌলতে ঠেকানো গিয়েছে সম্ভাব্য বহু ড্রপ-আউট। এরই সঙ্গে চলেছে ১৯৯৯ থেকে প্রতি শীতে নাট্যোৎসব, পত্রিকা প্রকাশ, বাউল উৎসব, পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন সংরক্ষণ, বৃক্ষরোপণের কাজ।

    গত ৩০ নভেম্বর এনআরএসের হেমাটোলজি বিভাগের প্রধান তুফানকান্তি দলুইয়ের পরিচালনায় হয়ে গিয়েছে রক্তরোগ বিষয়ে সচেতনতা শিবির। ২২ ডিসেম্বর হতে চলেছে ৯০তম রক্তদান শিবির। মাঝে ১০ ডিসেম্বর বিভূতিভূষণ সেবাসদনের রাজেন্দ্র গোলচা অপারেশন থিয়েটারে হয়ে গেল বিনামূল্যে ছানি অপারেশন শিবির।

    বর্ষশেষে তিন দিনের নাট্যোৎসব শুরু হচ্ছে ২৭ ডিসেম্বর। রাজ্যের নানা প্রান্তের ১০টি দল পরিবেশন করবে নানা স্বাদের নাটক। প্রবাদপ্রতিম বাদল সরকারের নাট্যপরিক্রমাতেও একদা যুক্ত থেকেছে থান্ডার।

    ক্লাবের দুই সম্পাদক রবিশঙ্কর সাঁবুই, তরুণ শীলরা বলেন, ‘চক্ষুদানের অঙ্গীকারপত্র সংগ্রহ, মরণোত্তর দেহদানের প্রচারও চলছে। স্কুল-পড়ুয়াদের মধ্যে থ্যালাসেমিয়া স্ক্রিনিংয়ের কাজ হচ্ছে। এলাকার মানুষের কর্মসংস্থানে মৎস্যচাষের ব্যবস্থাও করেছে থান্ডার।’ মাথা তোলার অপেক্ষায় মহাশ্বেতা আকাদেমি, সেবাসদনের পাশে সেই শিক্ষাকেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হয়েছে ইতিমধ্যে। থান্ডারের আর একটি কাজও নজর কেড়েছে। গত চার বছরে রাস্তার ধারে অসংখ্য গাছ লাগিয়েছেন ক্লাবের সদস্যরা। কয়েক হাজার গাছ মহীরুহ হওয়ার অপেক্ষায়। ঠিক যেমন সুবর্ণজয়ন্তী ছুঁতে চলা থান্ডার।

  • Link to this news (এই সময়)