মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা মতো ‘বাংলার বাড়ি’ প্রকল্পের প্রথম কিস্তির টাকা ঢুকতে শুরু করেছে উপভোক্তাদের অ্যাকাউন্টে। চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়া উপভোক্তাদের ‘মাস্টার রোল’ তৈরি করেছে নবান্ন। যার ভিত্তিতে ট্রেজ়ারির মাধ্যমে সরাসরি টাকা পাঠানো হচ্ছে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রায় ১২ লক্ষ উপভোক্তাকে প্রথম কিস্তির টাকা দেওয়া হবে।
যদিও দেখা গিয়েছে একাধিক জেলায় আবাসের বাড়ি তৈরির চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে বেড়েছে বালি, পাথর, সিমেন্ট, ইট ও রডের মূল্য। একই সঙ্গে মিস্ত্রি জোগানের ক্ষেত্রেও ঘাটতির আশঙ্কা থাকছেই। রাজ্যের বেশ কিছু জেলায় এরকম কিছু ঘটনাক্রম তুলে ধরল ‘এই সময়’।
বর্ধমান: ‘বাংলার বাড়ি’র উপভোক্তা বর্ধমান-১ ব্লকের রায়ান-১ পঞ্চায়েতের বাসিন্দা জবা মাহাতো। তিনি বলেন, ‘বাড়ির টাকা এখনও পাইনি। তবে আগাম খোঁজখবর নিয়ে দেখলাম সব কিছুরই দাম বেড়েছে। এলাকায় চার জন নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবসা করেন। তাঁদের থেকে জানলাম, সাত দিন আগেও ৯-১০ টাকায় বিক্রি হওয়া ইটের দাম এখন ১২ টাকা। ঢালাই পাথরের দাম কুইন্টালে ৫০-৭৫ টাকা বেড়েছে।’
বর্ধমান-২ ব্লকের হাটগোবিন্দপুরের উপভোক্তা সন্ধ্যা সাহা বলেন, ‘যে বালির দাম প্রতি ট্র্যাক্টর সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকা ছিল, তার দর এখন সাড়ে চার হাজার টাকা।’ তাঁর প্রশ্ন, ‘সরকার প্রথম কিস্তির ৬০ হাজার টাকা দেওয়ার পর, বাড়ির কাজ অর্ধেক এগিয়ে গেলে বাকি টাকা দেবে? এখন সব কিছুর যা দাম তাতে ওই টাকায় কী ভাবে এতটা কাজ হবে, বুঝতে পারছি না।’
পূর্ব বর্ধমানের জেলাশাসক আয়েশা রানি এ বিষয়ে বলেন, ‘নির্মাণ সামগ্রীর দাম আচমকা বেড়ে যাওয়ার খবর পেয়েছি। জেলা প্রশাসনের আধিকারিকরা ইতিমধ্যে আলোচনা করেছেন। সামগ্রীর কোনওরকম কালোবাজারি হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অতিরিক্ত জেলাশাসককে (সাধারণ) বিষয়টি দেখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
পূর্ব মেদিনীপুর: এই জেলার বিভিন্ন এলাকায় এক নম্বর ইট ১১-১২ হাজার টাকার মধ্যে। বালি ৪০০ সিএফটি ২২-২৩ হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া গেলেও চাহিদা বাড়লে দাম বাড়ার সম্ভাবনা দেখছেন অনেকে। জেলায় ৫৫ হাজার বাড়ি তৈরির নির্মাণ সামগ্রীর যোগানের ঘাটতি দেখিয়ে কালোবাজারি ও বাড়তি দাম নেওয়ার সম্ভাবনা থাকছেই। কালোবাজারি রুখতে নিয়মিত অভিযান চালানো হবে বলে জানিয়েছ জেলা ও ব্লক প্রশাসন।
বিভিন্ন এলাকায় ইট, বালি, স্টোনচিপ্স, রড ও সিমেন্টের দোকানে নিয়মিত নজরদারি চলবে। কালোবাজারির অভিযোগে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি পূর্ব মেদিনীপুরের জেলাশাসক পূর্ণেন্দু মাজির। তিনি বলেন, ‘এই প্রকল্পের উপভোক্তারা যাতে সঠিক দামে সঠিক মানের ইমারতি দ্রব্য পায় সে জন্যে কর্মশালা হবে। তাছাড়া কালোবাজারি রুখতে ভিন্ন এলাকায় চলবে নজরদারি।’ রামনগরের বাসিন্দা পেশায় রাজমিস্ত্রি রাজকুমার বেরা বলেন, ‘এখন বাড়ি তৈরির মরশুম। এমনিতে নতুন বাড়ি ও হোটেল তৈরির কাজ চলছে। এত বাড়ি তৈরির মিস্ত্রি পাওয়া যাবে কি না সেটা বলা মুশকিল।’
দুর্গাপুর: দুর্গাপুর মহকুমার একাধিক ব্লকে বাংলার বাড়ি প্রকল্পের টাকা ঢুকতে শুরু করেছে। কাঁকসা ব্লকের সাতটি পঞ্চায়েত মিলিয়ে প্রথম পর্যায়ে ৩০২ জন উপভোক্তা পেয়েছেন এই টাকা। শনিবার আরও ৭০০ জন উপভোক্তার অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকবে বলে জানিয়েছে ব্লক প্রশাসন। এই সুযোগে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী রাতারাতি নির্মাণ সামগ্রীর দাম বাড়িয়েছেন। ইতিমধ্যে এই খবর পেয়েছেন বলে জানান দুর্গাপুরের মহকুমাশাসক সৌরভ চট্টোপাধ্যায়।
তাঁর কথায়, ‘বালির ঘাটতিতে বাংলার বাড়ি প্রকল্পের কাজ যাতে বন্ধ না হয় সে জন্য বৈধ বালিঘাটের মালিকদের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। মুনাফার জন্য কেউ যদি চড়া দামে বালি বিক্রি করে তা হলে আইনি পদক্ষেপ করা হবে।’ পশ্চিম বর্ধমান জেলা তৃণমূল সভাপতি তথা পাণ্ডবেশ্বরের বিধায়ক নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘নির্মাণ সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে জেলাশাসকের সঙ্গে কথা বলব। অভিযোগ এলে আইনি ব্যবস্থা নেব।’
আসানসোল: বাংলার বাড়ি প্রকল্পের টাকা দেওয়া শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আসানসোল শিল্পাঞ্চলে বালি, ইট, স্টোনচিপ্সের দাম বেড়েছে। এখানে দামোদর ও অজয় নদী থেকে বালি তোলা হয়। স্থানীয় ঠিকাদার বাপি চৌধুরী জানান, মাসখানেক আগেও এক ট্র্যাক্টর বা ১০০ সিএফটি বালির দাম ছিল ১৬০০-১৭০০ টাকা। এখন তার দাম প্রায় হাজার টাকা করে বেড়েছে। চিমনি ভাটার ইটের দাম ৫০০-৭০০ টাকা করে বেড়েছে। প্রতি ১০০ সিএফটি স্টোনচিপ্সের দাম প্রায় ৫০০ টাকা করে বেড়েছে।
পুরুলিয়া: বাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে পুরুলিয়ায় বিরাট সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে বালি। গত কয়েক সপ্তাহে ব্যাপক কড়াকড়ি শুরু হয়েছে বালি উত্তোলনের ক্ষেত্রে। অভিযোগ, বালির আকাল হওয়ায় অনেকেই চোরাপথে বালি দিচ্ছে বহুগুণ দাম বেশি নিয়ে। এক টিন বালির দাম ৭০ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে! এক ট্র্যাক্টর বালির দাম পড়ছে ছ’হাজার টাকা। এত বেশি দামে বালি কিনে কী ভাবে ‘বাংলার বাড়ি’র কাজ করা সম্ভব হবে তা বুঝতে পারছেন না পুরুলিয়ার উপভোক্তারা।